শাকিবের যত চড়াই-উতরাই

শাকিব খান
শাকিব খান
>২০১৬ সালে যৌথ প্রযোজনার ছবি শিকারি দিয়ে পর্দায় এক নতুন শাকিব খানের দেখা মেলে। চারদিকে সাড়া ফেলে তাঁর সেই নতুন রূপ। বাংলাদেশের পাশাপাশি শাকিব ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও হয়ে ওঠেন আলোচিত। বলা যায় তারকা শাকিবের নবজন্ম ছিল সেই বছর। এবার বীর ছবিটি দিয়ে গত সপ্তাহে আবারও অন্য রকম সাজপোশাকে পর্দায় এলেন এই তারকা। অবশ্য তা শিকারির পরিবর্তনকে ছুঁতে পারেনি। শিকারি থেকে বীর পর্যন্ত শাকিবের অভিনয়জীবনে চড়াই–উতরাইয়ের হিসাব নিয়ে এই প্রতিবেদন। লিখেছেন শফিক আল মামুন

চড়াই–উতরাই নিয়ে শাকিব

একজন শিল্পীর সব ছবিই যে ব্যবসা করবে, তা তো নয়। একজন তারকাকে সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে সব ধরনের ছবিই করতে হয়। এর মধ্যে কিছু ছবি দর্শক গ্রহণ করে, কিছু ব্যবসায় পিছিয়ে যায়। আবার এমনও হয়, ব্যবসা না করলেও অভিনয় ও অন্য শৈল্পিক গুণে এগিয়ে থাকে আয়ের দিক থেকে ব্যর্থ হওয়া ছবি। তাই একজন তারকাশিল্পীর জন্য এই সাফল্য–ব্যর্থতার বিষয়টি খুবই আপেক্ষিক।

শিকারি ছবিতে শাকিব ও শ্রাবন্তী
শিকারি ছবিতে শাকিব ও শ্রাবন্তী

২০১৬: ‘শিকারি’ দিয়ে নবজন্ম
২০১৬ সালে শিকারি ছবি মুক্তির আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাকিব খানের নতুন সাজপোশাক আলোচিত হয়। ওই বছর ঈদুল ফিতরে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পায় ছবিটি। একঘেয়ে ঢালিউডি ছবির ভিড়ে দর্শক নতুনত্বের স্বাদ পেয়ে হলমুখী হন সে বছর। প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা বাজেটের এই ছবি থেকে বিনিয়োগ উঠে আসে দ্রুত। লাভবান হন শিকারির ঢাকা ও কলকাতার প্রযোজকেরা। ওই ঈদেই শাকিবের আরও দুটি ছবি মুক্তি পায় মেন্টাল: দ্য রানা পাগলা ও সম্রাট। কিন্তু শিকারি এতই উচ্চকিত ব্যবসা করে যে এর সামনে ফিকে হয়ে যায় বাকি দুটো ছবি। শিকারি যতটা ব্যবসা করে, শাকিবের অন্য দুটি ছবি ততটাই পিছিয়ে যায় আয়ের দিক থেকে। 

পাসওয়ার্ড ছবির পোস্টারে শাকিব
পাসওয়ার্ড ছবির পোস্টারে শাকিব

২০১৬: নতুন শাকিব, নতুন জুটি
একই বছরই ঈদুল আজহায় মুক্তি পায় শাকিব খানের আরও দুই ছবি—বসগিরি ও শ্যুটার। এই ছবি দুইভাবে দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথম কারণ নতুন রূপের শাকিব। অন্য কারণ হলো, শাকিবের বিপরীতে নবাগত নায়িকা বুবলীর অভিষেক। ফলাফল সফল হয় দুটো ছবিই। প্রযোজকদের দেওয়া তথ্যমতে দুটো থেকেই উঠে আসে বিনিয়োগ।

২০১৭: ভালো–মন্দের বছর
২০১৭ সালে ঈদুল ফিতরে বাংলাদেশ–ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবি নবাব দিয়ে শাকিব আবারও ঝলসে ওঠেন। প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি বাংলাদেশে বেশ ভালো আয় করে। এর ঠিক দুই মাস পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ৫০টি হলে মুক্তি পায় এই ছবি। কিন্তু তার আগেই পাইরেসি হয়ে যাওয়ার কারণে কলকাতায় সেভাবে সুবিধা করতে পারে ছবিটি। এর মধ্যে অহংকার–এর নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ায় তা থেকে আসা আয় দিয়ে লাভের খাতায় নাম লেখায় ছবিটি। অন্যদিকে রংবাজ থেকে পুরোপুরি পুঁজি উঠে আসেনি বলে জানান ছবির পরিচালক শামীম আহমেদ।

একই বছর আমি নেতা হবো নামে শাকিব খানের আরেকটি ছবি মুক্তি পায় সারা দেশে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোনো উৎসবকেন্দ্রিক দিনে এটি মুক্তি না পাওয়ায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা বাজেটের এই ছবি থেকে লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের। কিন্তু ২০১৭ সালেরই এপ্রিলে মুক্তি পাওয়া শাকিব খানের আরেক ছবি সত্তা একই সঙ্গে আয় করে ও প্রশংসাও পায়। সত্তা ছবির পরিচালক হাসিবুর রেজা কল্লোল জানান, প্রেক্ষাগৃহ ও ডিজিটাল স্বত্ব বিক্রি করে ছবির বিনিয়োগ প্রায় উঠে এসেছে।

নবাব–এ শাকিব
নবাব–এ শাকিব

২০১৮: লোকসানের পাল্লা ভারী
এই বছর শাপলা মিডিয়ার প্রযোজনায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা বাজেটের ছবি চিটাগাইংগা পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া থেকে বিনিয়োগ ফিরে পান প্রযোজক। বলছি ২০১৮ সালে ঈদুল ফিতরের কথা। এই একই উৎসব ধরে মুক্তি পায় সুপার হিরো। কিন্তু এই ছবি থেকে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হার্টবিট প্রোডাকশনের প্রায় দেড় কোটি টাকার লোকসান হয়, জানান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তাপসী ফারুক। ২০১৮ সালের ঈদুল আজহায় মুক্তি পায় শাপলা মিডিয়ার ছবি ক্যাপ্টেন খান। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম জানান, শাকিব অভিনীত ছবিটি থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা সমপরিমাণের লোকসান হয়েছে তাঁদের।

২০১৮: লোকসান ওপারেও
শাকিব খানকে নিয়ে ২০১৮ সালে পরপর দুটি ছবি তৈরি করে কলকাতার এসকে মুভিজ। সাড়ে ৫ কোটি রুপি বাজেটের ভাইজান এলো রে ও সাড়ে তিন কোটি রুপি বাজেটের চালবাজ। দুটি ছবি থেকেই বড় অঙ্কের লোকসান হয়েছে বলে জানান প্রযোজক অশোক ধানুকা। তবে শাকিবের পারফরম্যান্স নয়, তিনি লোকসানের জন্য অন্য কারণ দেখালেন। বললেন, ‘পয়লা বৈশাখ ও ঈদ—দুই উৎসব ধরে ছবি দুটি বানিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু ঝামেলার কারণে সাধারণ সময়ে ছবি মুক্তি দিতে হয়েছে।’

২০১৯: শুরুতে এগিয়ে, পরে পিছিয়ে
২০১৯ সালে এসে হিসাব পাল্টে যায়। ২০১৮–এর লোকসানের খাতা বন্ধ করে দেয় শাকিবের নিজের প্রযোজিত ছবি পাসওয়ার্ড। ছবির আয় থেকে বিনিয়োগ তো উঠে আসেই, সেই সঙ্গে লাভের মুখও দেখেন ছবির প্রযোজক ও অভিনেতা শাকিব খান। তবে একই সময়ে মুক্তি পাওয়া শাকিব খানের আরেক ছবি নোলক পিছিয়ে পড়ে আয়ের দিক থেকে। নোলক–এর মতোই অবস্থা ছিল ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া শাকিব খানের মনের মতো মানুষ পাইলাম না ছবিটির। এর প্রযোজক জানান, প্রায় আড়াই কোটি টাকা বাজেটে বানানো ছবিতে অর্ধকোটি টাকার লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে এই ক্ষতির জন্য পরিচালক জাকির হোসেন রাজু সে সময় চলা টানা বৃষ্টি ও ডেঙ্গুর আতঙ্ককে দুষলেন।

বীর ছবির পোস্টার
বীর ছবির পোস্টার

২০২০: ‘বীর’ দিয়ে সুবাতাসের ইঙ্গিত
পরিচালক কাজী হায়াৎ নির্মিত ছবি বীর মুক্তি পেয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। শাকিব খান অভিনীত এ বছরের প্রথম ছবি এটি। ভালো খবর হলো, এরই মধ্যে ছবি থেকে বিনিয়োগ ওঠে আসতে শুরু করেছে। জানালেন নির্মাতা কাজী হায়াৎ। যদিও বীর নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না। তবে ছবির নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ায় শাকিব অভিনীত বীর লোকসানের দিকেও যায়নি। তাই চড়াই আর উতরাইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করেই চলছেন নায়ক শাকিব খান। 

শাকিবের ব্যর্থতার কারণ

১. আমাদের পরিচালকেরা শাকিব খানকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না। তাঁর মতো পাকা অভিনেতাকে নিয়ে আলাদা করে নিরীক্ষাধর্মী কাজ কেউ করছেন না। 

২. শাকিব খান বৈচিত্র্যময় গল্পে কাজ করেন না। একই ধরনের চিত্রনাট্য বারবার বেছে নেন। 

৩. অনেক সময় দেখা যায়, শাকিব ভালো অভিনয় করছেন, পরিশ্রম করছেন। কিন্তু ছবির গল্পই ভালো না বা চিত্রনাট্য দুর্বল। এ কারণেও শাকিবের ওপর ব্যর্থতার দায় বর্তায়।

 সাফল্যের কারণ

১. একজন হিরোর যতটা স্মার্ট হওয়া দরকার, শাকিব খানের মধ্যে ততটাই স্মার্টনেস আছে। তাঁর চলাফেরা, পোশাক, ব্যক্তিত্ব পুরোটাই নায়কোচিত। তিনি এত বছর ধরে এই ব্যক্তিত্ব সাফল্যের সঙ্গে ধরে রেখেছেন। 

২. শাকিব বেছে বেছে কাজ করেন। তারপরও আরেকটু সচেতন হতে হবে। 

৩. নিজের কাজে শাকিব খান পারফেকশন খোঁজেন। বিষয়টি ঠিকঠাকমতো মেনে চলতে পারলে তিনি আরও এগিয়ে যেতে পারবেন। 

মতিন রহমান
নির্মাতা ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক