গন্তব্যই ছিল গান

আরমীন মূসা। ছবি: হাসনাইন হাফিজ
আরমীন মূসা। ছবি: হাসনাইন হাফিজ

আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ভালো ফলকে অন্য সব প্রতিভার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। আরমীনের ভাষায়, ‘গানে ভালো, নাচে ভালো বা আবৃত্তিতে ভালো হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কে অঙ্কে কত মার্কস পেল, বিজ্ঞানে কত পেল—এসব। তাই আমি একসময় চাইতাম সেই মার্কসের পেছনে ছুটতে। যেন কেউ আমাকে বলতে না পারে যে আরমীন গান করতে করতে পড়ালেখাটা করল না।’

স্কুলের গণ্ডি পর্যন্ত কেউ কিছু বলতেও পারেনি তাঁকে। কারণ, আরমীন সব বিষয়েই পেতেন ফুল মার্কস। তাই গানের সময় গান করতেন, আর পড়ার সময় পড়তেন। ইচ্ছা ছিল ভর্তি হবেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা তাঁর নানা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মতো লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) থেকে পড়বেন অর্থনীতি কিংবা আইন বিষয়ে। সব গোছগাছই ছিল। তবে এ লেভেলের আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আরমীন। সেটা ২০০৪ সালের কথা। এ কারণে জীবনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষায় খারাপ করেন আরমীন। পরিসংখ্যানে পান ‘সি’ গ্রেড। সেই দুঃসময়ের কথা কিছুতেই ভুলতে পারেন না এই শিল্পী। তবে তাঁর দুর্ভাগ্যই যে তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল গানের দিকে, এটা সে সময় বুঝতে পারছিলেন না তিনি।

আইন নিয়ে পড়াশোনা ও ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’

পরিবারের সবার কথা শুনে অক্সফোর্ড আর এলএসইর স্বপ্ন ছেড়ে আরমীন ভর্তি হন যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়তে। কিন্তু আইন নিয়ে পড়াশোনায় মোটেও মন টিকছিল না তাঁর। ওই সময় ডরমেটরির ছোট্ট রুমে বসে আরমীন তাঁর খারাপ লাগা ঘোচাতেন নানান দেশের শিল্পীদের গান শুনে। ঢাকায় থাকতে গানের জন্য আরমীন সব সময় ছুটে যেতেন অর্ণব আর শাহানা বাজপেয়ীর কাছে। শিল্পী হিসেবে এঁদের সান্নিধ্যেই আরমীন নিজেকে বিভিন্ন সময় ঝালিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া ওই সময়টায় আরও অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ বাড়তে থাকে তাঁর। নিউইয়র্কে পড়তে যাওয়ার আগে ফুয়াদ আল মুক্তাদিরের সঙ্গে ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ গানের কাজ শেষ করে যান। ২০০৫ যখন গানটি বাংলাদেশের শ্রোতাদের মধ্যে আলোড়ন তোলে, তখন আরমীন এসব থেকে অনেক দূরে, আইনের নানান ধারা মুখস্থ করতে করতে রীতিমতো অবসাদগ্রস্ত। তবে সেই সময়ই আরমীন স্বপ্ন দেখতেন, এসব পড়াশোনার পাট চুকিয়ে, হাতে একটা সনদ পেলেই গানের সঙ্গে বসবাস শুরু করবেন। 

এবার অর্থনীতিতে পড়াশোনা, মন পড়ে ছিল গানে

কিন্তু আইন নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে পারেননি আরমীন। মন টেকাতে না পেরে বছরখানেক পর অর্থনীতি বিষয়ে পড়তে ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামে। উপভোগই করছিলেন আরমীন। তবে সেই যে ভালোবাসা, সেটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখনো আরমীনকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল সংগীত। এ সময়টায় আরমীন জানতে পারেন বার্কলে কলেজ অব মিউজিকের কথা। আবার এক নতুন স্বপ্ন তাঁকে পেয়ে বসে। একটা স্নাতকের মাঝখানেই আরেকটি করার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু বার্কলে কলেজ অব মিউজিক আদতে অনেক ব্যয়বহুল। তাই এই স্বপ্ন যে অধরা, তা মেনেই নিয়েছিলেন তিনি। আরমীনের বয়স তখন ১৮ কিংবা ১৯ বছর। 

আরমীন নিজের গল্প বলতে বলতে আমাদের জানান, গানই একসময় মূল পেশা হবে, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। যদিও সংগীত–পরিবারে বেড়ে ওঠা আরমীনের গানের চর্চা কথা বলতে শেখার আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আরমীন বলেন, ‘আমার বড় বাবা লোকগীতির কিংবদন্তি আব্বাসউদ্দীন আহমদ, মা নাশিদ কামাল, নানি (নাশিদ কামালের ফুফু) ফেরদৌসী রহমান। তারপরও পুরোপুরি গানই হবে পেশা, এটা কেউ কখনো চাননি। কারণ, আমাদের পরিবার জানত যে এই দেশে পেশাগতভাবে শিল্পী হওয়া কতটা কঠিন ও সংগ্রামমুখর।’

মা নাশিদ কামালেরে সঙ্গে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আরমীন
মা নাশিদ কামালেরে সঙ্গে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আরমীন

গান শিখতে বিশ্বভারতীতে
এরপরও আরমীন কঠিন পথটাই বেছে নেন। অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করার পর ভারতীয় সংগীত নিয়ে পড়ার জন্য বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন তিনি। বছরখানেক সেখানে স্নাতক শুরুর আগে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রস্তুতিপর্বে পড়েন। এর ফাঁকে ফাঁকে ঢাকায় এসে বিভিন্ন হোটেল ও রেস্তোরাঁয় গান করতেন, টুকটাক আয়ও হতো। তবে সে সময় অর্ণব একটা কথা বলেছিলেন আরমীনকে, যা তাঁর জীবনের পরের পথটুকুর নকশা এঁকে দিয়েছিল। অর্ণব বলেছিলেন, ‘তুমি গান লিখতে পারো, সুর বুঝতে পারো। তাই শুধু কণ্ঠশিল্পী হওয়ার চেষ্টা না করে, সংগীতায়োজন, সুর এসব নিয়ে আরও গভীরভাবে কাজ করো। ভালো করবে।’

এই কথা মাথায় ঢুকে যায় আরমীনের। বিশ্বভারতীতে তখন নিজেকে আবারও একা আর অসম্পূর্ণ মনে হতে থাকে তাঁর। বছরখানেক পড়েই ঢাকায় ফিরে আসেন। পরিবারের কথায় ঢাকাতেই অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এর মধ্যে খবর পান, এবারই প্রথম ভারতে বার্কলে স্কুল অব মিউজিক কর্তৃপক্ষ আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অডিশন নিতে আসছে। তার আগে এশীয় শিক্ষার্থীদের জন্য জাপানে হতো অডিশন। সেবার অর্থাৎ ২০০৯ সালে, ভারতের মুম্বাইয়ে অডিশন হবে শুনে আরমীন নিজের ভাগ্যপরীক্ষা করে দেখার জন্য নাম লেখান ভর্তিপ্রার্থীদের তালিকায়। একা একাই যান মুম্বাইয়ে। অডিশনের জন্য জীবনে প্রথমবারের মতো তুলেছিলেন জ্যাজ গান, গেয়েছিলেন একটা বাংলা গানও। কিন্তু নানান দেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের মেধা দেখে রীতিমতো হতাশ হয়েই দেশে ফিরে আসেন আরমীন। শুরু হয় অপেক্ষার পালা, কিন্তু বার্কেলে থেকে আর ডাক আসে না। 

বার্কলের গানের কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন
প্রত্যাখ্যাত হবেন, এটা মেনে নিয়েই অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করার জন্য তৈরি হন আরমীন মূসা। মা নাশিদ কামাল নিজে স্নাতকোত্তরে ভর্তির ফরম পূরণ করে দেন। কিন্তু ভর্তির ঠিক আগের রাতে চিঠি আসে, বার্কলে কলেজ অব মিউজিকে পড়ার জন্য উত্তীর্ণ হয়েছেন আরমীন। কিন্তু এই চিঠি তাঁকে অতটা খুশি করতে পারেনি। কারণ, হিসাব কষে দেখলেন সেখানে পড়ার জন্য প্রতিবছর প্রায় ৪৪ লাখ টাকা লাগবে। আরমীন সে সময়ের কথা মনে করে বলেন, ‘আমার পড়াশোনার পেছনে আমার পরিবারের যতটা বিনিয়োগ করার ছিল, তারা ততটাই করেছে। এখন স্নাতকোত্তর না করে, আরেকটা স্নাতকের জন্য কীভাবে টাকা চাই? তার ওপর খরচ অনেক বেশি।

আমার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল, তা ঠিক। তবে এতটাও আবার নয় যে এতগুলো টাকা দিতে পারবে।’

আরমীন গান নিয়ে পড়ার স্বপ্ন ছেড়ে দেন। কিন্তু তারপর আরেকটা ই–মেইল পান তিনি, যা নিবু নিবু আশার আলোকে আবার জিইয়ে তোলে। জানতে পারেন, এশিয়া থেকে একটি বিশেষ বৃত্তি পেয়েছেন তিনি, যা শুধু ৫ জন শিক্ষার্থীই পায়। এবং এর ফলে শুরুর দিকে পড়ার খরচের ৫০ শতাংশই বহন করে বিশ্ববিদ্যালয়। আরমীন সেই ৫ জনের একজন। এরপর শুরু হয় বাকি ৫০ শতাংশ টাকা জোগাড়ের যুদ্ধ। ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন বলে কাগজপত্র ঠিক করেন। কিছু টাকা তাঁর নানি হোসনে আরা কামাল আরমীনের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, সেটাও তোলেন ব্যাংক থেকে। এরপর একদিন হঠাৎ আরমীনকে তাঁর নানা মোস্তফা কামাল ডেকে নেন। নিজের সঞ্চয়ের কিছু টাকা দিয়ে বলেন, এটা তিনি নাতনির জন্য তুলে রেখেছিলেন। যেখানে পরিবারগুলো অর্থ সঞ্চয় করেন বাড়ির মেয়ের বিয়ের জন্য, সেখানে আরমীনের পরিবার তাঁর পড়ার জন্য সেই সঞ্চয় ব্যয়ে দ্বিধা করে না। অবশেষে আরমীন প্রস্তুত বার্কলেতে যাওয়ার জন্য। এবং এরপরই পা রাখেন নিজের স্বপ্নের গানের কলেজে। 

গানের জন্য দেশে ফেরেন 

২০১৫ সালেই আরমীন মূসা ফিরে আসেন বাংলাদেশে। কাজ শুরু করেন বাংলা গান নিয়ে। গড়ে তোলেন গানের দল ‘ঘাসফড়িং কয়্যার’ ও দ্য আরমীন মূসা ব্যান্ড। এ পর্যন্ত আরমীন ও তাঁর দলের বেশ কয়েকটি গান বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে, হয়েছে ভাইরাল। যেমন বার্কলে কলেজ অব মিউজিকের ইউটিউব চ্যানেলে থাকা ‘জাগো পিয়া’, ঘাসফড়িং কয়্যারের অর্ণবের গান নিয়ে বিশেষ সংকলন ও গত বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলতাফ মাহমুদের কালজয়ী একুশের গানটিও আরমীনের কাজকে নিয়ে এসেছে সবার সামনে। কিন্তু এরপরও আরমীনের কাছে মনে হয়, শুধু শিল্পী হিসেবে গানের মধ্যে বেঁচে থাকা আমাদের সামাজিক পারিপার্শ্বিকতায় বেশ সংগ্রামের। আরমীনকে আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকার জন্য গানের পাশাপাশি ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে, শিশুদের গান শেখাতে হচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে অংশ নিতে হচ্ছে। এত
কিছুর পরও গান নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করছে। কিন্তু এই শূন্যতা নিয়েও
গান তাঁকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পরিচয়ে বাঁচতে শেখাচ্ছে। আর এত কিছুর পর এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

এ আর রাহমানকে সম্মানসূতচক ডিগ্রি দেওয়ার অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে রাহমান ও আরমীন। ছবি: প্রকাশ সিনহা
এ আর রাহমানকে সম্মানসূতচক ডিগ্রি দেওয়ার অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে রাহমান ও আরমীন। ছবি: প্রকাশ সিনহা

বার্কলে, আরমীন এবং এ আর রাহমান

বার্কলেতে গিয়ে আরমীন মূসা প্রথম দিন থেকেই শিখতে শুরু করেছিলেন। এটা তাঁর চতুর্থ বিশ্ববিদ্যালয়। আর সেখানে পা রেখেই বুঝে গিয়েছিলেন অবশেষে নিজের জায়গায় এসে পৌঁছেছেন। ওই সময়টাতেই যে পরিমাণ সংগ্রাম তিনি করেছেন, তা তাঁকে আজকের অবস্থানে টিকে থাকতে সাহায্য করছে বলেই বিশ্বাস করেন। সে সময় পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনযাপনের খরচ জোগাড় করতে আরমীন একসঙ্গে তিনটি খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। প্রবাসী বাঙালি শিশুদের গান শেখাতেন আর রাতে বিভিন্ন দালানের দেয়ালে পোস্টার লাগাতেন। খণ্ডকালীন চাকরির সংখ্যা কমানোর জন্য আরমীনকে প্রচুর পড়তে হতো, গানের চর্চা করতে হতো। অবশেষে আরমীনের বৃত্তি ৫০ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে ১০০ শতাংশে পৌঁছায়। শেষ দিকে বৃত্তি পেয়ে পুরোপুরি বিনা বেতনেই বার্কলেতে পড়েছেন আরমীন। একই মঞ্চে গান করেছেন এ আর রাহমানের সঙ্গে। বাংলা গান হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বড় সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউটিউব চ্যানেলে একমাত্র আরমীনের গানই আছে, নাম ‘জাগো পিয়া’। বাংলাদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে বার্কলে কলেজ অব মিউজিকে আরমীন বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। এ আর রাহমানকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয় ২০১৫ সালে। ওই বছর ১০১ জনের কয়্যারে বাংলাদেশি শিল্পী আরমীন অডিশন দিয়ে প্রথম সারির ১৪ শিল্পীর একজন হিসেবে নাম লেখান। বার্কেলে সফরের শেষ দিকে এসে এই অর্জন তাঁর সব সংগ্রাম ও কষ্টের সেরা পুরস্কার হয়ে আছে।