ভাষার দেয়াল ভাঙছে সাবটাইটেল

প্যারাসাইট–এর জন্য জেতা অস্কার হাতে নির্মাতা বং জুন–হো
প্যারাসাইট–এর জন্য জেতা অস্কার হাতে নির্মাতা বং জুন–হো

বিশ্বায়নের যুগে পুরো পৃথিবী একটি একক অঞ্চল হয়ে উঠছে। ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রসারের এই সময়ে দুনিয়া বিশ্বগ্রামে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এই গ্রামেও বেড়া আছে, তা হলো ভাষার বেড়া। সেই বেড়া ডিঙানোর একমাত্র উপায় সাবটাইটেল। এভাবেই ভেঙে যাচ্ছে ভাষার দেয়াল। আর এর নেপথ্যে প্রধান সৈনিক হলো ভিডিও স্ট্রিমিং। 

মনোনয়ন ১৮২টি, পুরস্কার ২০৩টি

প্যারাসাইট ছবির অস্কার জয় সাবটাইটেলের এই অগ্রযাত্রাকে আরও ডিজেল-পেট্রল দিচ্ছে। এবারের অস্কার আসরে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশি ছবি সেরা চলচ্চিত্রের তকমা পেয়েছে। সাবটাইটেল-নির্ভর ছবির জন্য এটি অনেক বড় বিজয়। গোল্ডেন গ্লোবের ট্রফি হাতে প্যারাসাইট পরিচালক বং জুন-হো বলেছিলেন, ‘সাবটাইটেলের এক ইঞ্চি লম্বা বাধা একবার পার করতে পারলেই, অসংখ্য অসাধারণ চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাবে।’ ঠিক তেমনি সাবটাইটেল ডিঙিয়ে এখন হয়তো একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসও দেখা পেয়েছে অন্য সংস্কৃতির অনবদ্য সৃষ্টির। 

সাবটাইটেল ছবির প্রতি অস্কার বা বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণী কর্তৃপক্ষের বাঁকা চোখে তাকানোর প্রবণতা বহু দিনের। এবার তাতে বাদ সেধেছে প্যারাসাইট। এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে ১৮২টি মনোনয়ন পেয়ে ২০৩ বার বিজয়ীর হাসি হেসেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ছবিটি। এর মধ্যে আছে চারটি অস্কার ট্রফিও। আর গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা, কান ইত্যাদি তো আছেই। 

অস্কারজয়ী রোমা ছবির দৃশ্য
অস্কারজয়ী রোমা ছবির দৃশ্য

ব্যবসায়ও এগিয়ে...

তবে শুধু পুরস্কার পেলেই তো হবে না, কিছু টাকাকড়িও দরকার। এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসছে সাবটাইটেল–নির্ভর ছবি। পশ্চিমা বিশ্বে প্যারাসাইট ছবিটি এখন ঘরে বসে দেখার সুযোগ আছে, সেই সঙ্গে আছে সিনেমা হলেও। মজার বিষয় হলো, তারপরও সিনেমা হলে ছবিটির ব্যবসা কমেনি। অস্কার জয়ের পর গত কয়েক দিনে প্যারাসাইট বক্স অফিস থেকে সার্বিকভাবে আয় করেছে প্রায় দুই কোটি ডলার। আর ৫০ লাখ ডলার আয় করতে পারলেই অস্কার জয়ের পরের দিনগুলোয় সবচেয়ে বেশি আয় করা ছবির তালিকায় শীর্ষে উঠে যাবে বং জুন-হো পরিচালিত এ চলচ্চিত্র। 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাবটাইটেল–নির্ভর ছবির শিল্পমান ও বাণিজ্য—কোনোটাই খারাপ নয়। শুধু প্যারাসাইট এ ক্ষেত্রে একমাত্র উদাহরণ নয়। গত দুই দশকে আরও অনেক সাবটাইটেল–নির্ভর ভিন্ন ভাষার ছবি হলিউডে ডলারের রাজ্যে রাজত্ব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রোমা (২০১৮), প্যানস ল্যাবিরিনথ (২০০৬), অ্যামিলি (২০০১), ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন (২০০০) প্রভৃতি।  

অ্যামিলি ছবির দৃশ্য
অ্যামিলি ছবির দৃশ্য

ভাঙছে ভাষার দেয়াল

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূলধারার চলচ্চিত্রে সাবটাইটেল ব্যবহারের প্রবণতা ইদানীং বাড়ছে। আর এর পেছনে প্রধান ক্রীড়নক নেটফ্লিক্স, অ্যাপল টিভি, ডিজনি প্লাসের মতো বিভিন্ন ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট। ইন্টারনেট দিন দিন সহজলভ্য হওয়ায় এসব ভিডিও স্ট্রিমিং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য স্থানীয় ভাষায় নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরি করছে এবং অন্য অঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষী দর্শকদের জন্য তাতে থাকছে সাবটাইটেল। ফলে সাবটাইটেলের ব্যবহার যেমন একদিকে বাড়ছে, তেমনি অন্যদিকে বাড়ছে এতে দর্শকদের অভ্যস্ত হওয়ার হার।

উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে নেটফ্লিক্সের কথা। এই ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট এখন ২৮টি ভাষায় তৈরি কনটেন্টে সাবটাইটেল ব্যবহার করে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় তৈরি এসব কনটেন্ট অন্যান্য অঞ্চলের দর্শকেরাও দেখার সুযোগ পান। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তাদের সেবাগ্রহীতারা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতির বাধা খুব একটা মানছেন না। বরং ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির কনটেন্ট দেখাতেই দর্শকদের আগ্রহ বেশি। এই প্রবণতা দেখে অন্যান্য ভিডিও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটও এখন ইংরেজি ভিন্ন অন্যান্য ভাষায় কনটেন্ট তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। আর তাতে সবার বোঝার নিমিত্তে থাকছে সাবটাইটেল। 

এভাবেই ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের হাত ধরে ফিরে আসছে সাবটাইটেল ছবির রমরমা দিন। যেখানে কোনো ভাষা ভিনদেশিদের দূরে ঠেলে না। বরং সাবটাইটেলে ভর করে পৌঁছে যায় সব মানুষের কাছে। 

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, হাফপোস্ট, সিএনএন ও ভ্যারাইটি