একটি দিনে একটি জীবন

রবিবার ছবির দৃশ্যে প্রসেনজিৎ ও জয়া আহসান
রবিবার ছবির দৃশ্যে প্রসেনজিৎ ও জয়া আহসান

হৃদয়ে বেদনা জমে। কারণ আমরা নিজের মুখোমুখি হই। রবিবার ছবিটা দেখার পরে।

অতনু ঘোষ এবার এমন একটি ছবি বানিয়েছেন, যা ধীর প্রবাহে মনের ওপর দিয়ে বইয়ে যেতে দিতে হয়। ছকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত বাঙালি দর্শকদের দিক থেকে ভাবলে, রবিবার ছবিতে অতনু ঘোষ দুঃসাহসী ঝুঁকি নিয়েছেন। এ ছবিতে বৃত্তাকার গল্প নেই। ছবি এগিয়ে চলে মন্থর লয়ে। পর্বে পর্বে মোচড় নেই। সমাপ্তি কুহেলিকায়। ছবির বড় অংশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আলো–আঁধারীময় ফ্রেমের মতো এ ছবিটিতে আছে অস্পষ্টতা। বরং বলব, অমোঘ ও বিস্ফোরক অস্পষ্টতা। ফলে ছবি দেখা শেষে দর্শক নিজের নিজের মতো বিচিত্র ভাষ্য নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরোবেন। রবিবার ছবিতে অতনু ঘোষ বাঙালি সিনেমা–দর্শকদের একটি সেরিব্রাল অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছেন।

ছবির শুরু এক দুঃস্বপ্নে। ছবিটির প্রধান নারীচরিত্র সায়নী টর্চ হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায়ান্ধকার এক ঘরের মেঝেতে ছড়ানো তাড়া তাড়া চিঠি হাতড়ে বেড়ায়। এর পর পর কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে ওঠে এক অপূর্ণ ভ্রুণের বুকের ঢিপঢিপ। এ দুঃস্বপ্ন যেন দেজাভ্যু। তার একদিকে আছে সায়নীর মনে কাঁটার মতো গেঁথে থাকা এক অতীত। একই সঙ্গে এ ছবি যেখানে আমাদের পৌঁছে দেবে, তারও এক নিয়তিময় পূর্বদর্শন। পরে আমরা দেখতে পাব, অসীমাভ আর সায়নীর মধ্যে আবার তেতো হয়ে ফিরে আসবে তাদের না জন্মানো এই সন্তানের কথা। অসীমাভর না পাঠানো অজস্র চিঠির মাঝখানে আবার বেপথু হয়ে পড়বে সায়নী। কিন্তু অতনু ঘোষ মৃদু এই ইঙ্গিতের চেয়ে বেশি এক পা এগোন না। তিনি এগিয়ে চলেন নানা অস্পষ্ট ইঙ্গিত রেখে রেখে।

এক ছুটির দিনের ঢিলেঢালা সকালে পনেরো বছর পর সায়নীর সঙ্গে অসীমাভর দেখা। হয়তো হঠাৎ। আবার কে জানে, অসীমাভই এ সাক্ষাতের পরিকল্পনা করে রেখেছিল কি না, মনে মনে। আজকের দিনটিতেই যে অসীমাভ নিজের জন্য এক চরম নিয়তি নির্ধারণ করে রেখেছে। অসীমাভ জালিয়াত। ভালোবেসেছিল সায়নীকে। আবার অন্য এক মেয়ের কাছে চলেও গিয়েছিল সায়নীকে ছেড়ে। কিন্তু সায়নীকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। ফুরিয়ে যায়নি সায়নীর সঙ্গে ওর মানসাঙ্কের বোঝাপড়া। নিয়তিময় এই দিনে অঙ্কটি না মিললে ওর জীবন যে অচরিতার্থই রয়ে যাবে।

বুদ্ধিমতী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী সায়নী এখন সুস্থির জীবনে প্রতিষ্ঠিত। এক আইনি প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা সে। জালিয়াতির মনোগঠন নিয়ে লেখা ওর একটি বইও প্রকাশের অপেক্ষায়। অসীমাভ নানা ছলে আজকের দিনটিতে সায়নীর সান্নিধ্য চায়। সায়নীকে বাইরে থেকে দেখায় অনিচ্ছুক। কিন্তু আসলেই কি অনাগ্রহী সে? নইলে বারবার চলে যাওয়ার কথা বললেও কেন সে থেকে যায় অসীমাভর সঙ্গে, আষ্টেপৃষ্ঠে, গভীর রাত অব্দি?

দুই চরিত্রের টানাপোড়েনে ছুটির শিথিল দিনটি ভেঙে ভেঙে পড়ে—সায়নীর নিজের সঙ্গে নিজের ছলনায়; আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সায়নীর সঙ্গে অসীমাভর সেতু গড়ে তুলতে পারার ব্যর্থতায়। একটি দিনের মধ্য দিয়ে তাই এক প্রশ্নময় ও উত্তরহীন জীবন পাক খেতে খেতে এগোয়।

অসীমাভ চরিত্রটি চিত্রনাট্যকারের মনোযোগ পেয়েছে বেশি। চরিত্রটি তবু পাতা খোলা বইয়ের মতো। বলতে পারি সরল। সে জালিয়াত, কিন্তু সায়নীর সামনে ভঙ্গুর। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রে আলোছায়ার হেরফের হয় না। কিন্তু সায়নীর রূপবদল ঘটতে থাকে ছবির পর্বে পর্বে। বাইরে মোড়কের পর্দা খুলতে খুলতে ক্রমশ প্রকাশিত হয় তার ভেতরের চেহারা। ওর প্রতি দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সায়নী যখন নিজের বইয়ের জন্য অসীমাভকে তাকে জালিয়াত–জীবনের স্বীকারোক্তি দিতে বলে, কিংবা অসীমাভর জাল স্বাক্ষরে যখন সায়নীর মুশকিল আসান হয়—আমরা বুঝতে পারি, আপাত সুস্থির সায়নী ভেতরেও সুপ্ত রয়েছে অসীমাভর মতো আরেকটি সত্তা। সে আলোছায়ার ছোপ লাগা এক ঘোর কুজ্ঝটিকা। অসীমাভ চরিত্রটির মসৃণ সমতলে সায়নী চরিত্র ছুটে গেছে চোরাস্রোতে বঙ্কিম নদীর মতো।

রবিবার ছবিটি মূলত অসীমাভ আর সায়নী চরিত্রের এক যুগলবন্দি। তাদের সংলাপে, স্বগতোক্তিতে এবং অনুক্ত মুহূর্তে ছবিটি এগিয়ে চলে একমুখী ধারায়। অসীমাভ প্রকাশ্য, সায়নী লুকোচুরিময়। অসীমাভ কাতর, সায়নী ঋজু। পরস্পর–বিরোধী এই দুই চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর জয়া আহসানের অভিনয় বিদ্যুৎগর্ভ হয়ে উঠেছে। অচরিতার্থ, ভঙ্গুর ও কাতর অসীমাভ চরিত্রে অতনু ঘোষের হাতে অভিনেতা প্রসেনজিতের এ এক নতুন উদ্ভাস। মিতবাক সায়নীর চরিত্রে ভেতরের আর বাইরের বিপরীত দোলাচল ফুটিয়ে তোলায় জয়া আহসান আশ্চর্য সুমিত ও সংযত। জয়া অনুচ্চ অভিনয়ের যে কুশলতা অর্জন করেছেন, সায়নী তাতে জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে।

ছবির পার্শ্বচরিত্রগুলো অস্ফূট। সেসব চরিত্রের অভিনয়ও ছবির সামগ্রিক অভিনয়ের সুরের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু এ ছবি যে অভিজ্ঞতা দেয়, তার সামনে এসব প্রক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে থাকে।

চলচ্চিত্রে যাঁরা উপলব্ধির খোঁজ পেতে চান, রবিবার তাঁদের জন্য।