কেবল শিল্পী নয়, শিল্পেরও চিকিৎসা দরকার

মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত
মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত
>

ঢালিউডের খলনায়ক মিশা সওদাগর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মুক্তি পাওয়া ‘বীর’ ও ‘শাহেনশাহ’ ছবি দুটিতে অভিনয় করেছেন তিনি। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে চলচ্চিত্রের মন্দা, সমিতির কার্যক্রম ও নিজেদের নানা ব্যর্থতা নিয়ে কথা বললেন এই অভিনেতা। পাশাপাশি দিয়েছেন কিছু দিকনির্দেশনাও।

‘বীর’ ও ‘শাহেনশাহ’ ছবি দুটি পরপর মুক্তি পেয়েছে। কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
বেঁচে থাকার জন্য আমাকে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। এ পর্যন্ত সাত শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছি। সত্যি বলতে, আমার ঝুড়িতে কারুকাজের ছবি কম। সেই দিক থেকে বলতে হয় ‘বীর’ আমার কারুকাজের একটি ছবি। এটি আমার বড় প্রাপ্তি। আমি পরিচালক কাজী হায়াতের কাছে কৃতজ্ঞ, ছবির দুই প্রযোজকের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। ‘বীর’ একটি দেশপ্রেমের ছবি। এই ছবিতে আমাকে আলাদা গেটআপ নিতে হয়নি। সাধারণ মানুষের বেশভূষায় অভিনয় করেছি। কিন্তু চরিত্রটি আমাদের সমাজের চেনা। কোনো রংঢং ছাড়াই যে একটি চরিত্র অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, ‘বীর’ তার প্রমাণ। আমি চম্পাকলি হলে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সেটা বুঝেছি। ছবিটি দেখার পর সোহানুর রহমান সোহান, গাজী মাহবুবসহ অনেক পরিচালকই আমার কাজটির প্রশংসা করেছেন। সেন্সর বোর্ড থেকে শুরু করে সহকর্মী, ভক্ত-দর্শকদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।

আর শাহেনশাহ?
‘শাহেনশাহ’ ছবিটি এখনো দেখিনি আমি। তবে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের দু-একজনের কাজ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। নায়ক বাপ্পী ছবিটি দেখে আমাকে ফোনে বলেছেন, শুরু থেকে জমেনি। আমার প্রবেশের পর থেকেই নাকি ছবি জমে উঠেছে। তবে এই ছবি থেকে ‘বীর’-এর মতো সাড়া পাইনি।

কেন, এই ছবির নির্মাণ ও গল্পের মান ভালো নয়?
সেটা বলব না। কারণ, এই ছবি প্রায় দুই বছর আগে তৈরি। বারবার মুক্তি পিছিয়েছে। দর্শকেরা এবারও মুক্তির তারিখ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। ছবি তৈরির পর গরম গরম মুক্তি না পেলে ওই ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে যায়। তা ছাড়া মুক্তির পর করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছবিটিকে অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে।

মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত
মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত


অনেকে বলেন, মিশা সওদাগরের মতো অভিনেতাকে দিয়ে বৈচিত্র্যময় চরিত্রে কাজ করানো সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ ছবিতেই তাঁকে টিপিক্যাল খলনায়ক হিসেবে দেখা যায়। উচ্চ স্বরে সংলাপ বলা থেকে শুরু করে একই অঙ্গভঙ্গি। আপনার কখনো এসব মনে হয়নি?
আপনার সঙ্গে অনেকাংশে একমত। অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। হয়তো আমাকে নিয়ে ওই ধরনের এক্সপেরিমেন্ট হয় না। তবে কিছু কিছু যে হয়নি, তা নয়। যেমন ‘নিশ্বাস আমার তুমি’, ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’সহ বেশ কিছু ছবির পরিচালক আমাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেই চেষ্টা কম। তবে ছোট পর্দা থেকে আসা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, শিহাব শাহিন, অনন্য মামুনরা তাঁদের কাজে আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। এটি সত্য যে আমাকে বেশির ভাগ ছবিতেই সব সময় একধরনের গৎবাঁধা চরিত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে চিৎকার, চেঁচামেচির সংলাপই বেশি। দেখুন, ফরীদি ভাইয়ের মতো অভিনেতাকেও একইভাবে ফর্মুলায় ফেলে ব্যবহার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ছবিতেই উচ্চ স্বরে সংলাপ বলতে দেখা গেছে। এটি বাণিজ্যিক ছবির দীর্ঘদিনের প্রচলিত ভঙ্গি। কিন্তু এটি স্থায়ী নয়। পরিবর্তন হতে পারে। সেটা আমরা কজন করছি? রাজ্জাক সাহেবের পর সালমান শাহ স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করে মানুষের মন জয় করেছেন। অতিরঞ্জনের তো দরকার নেই। অভিনয়টা অভিনয়ের মতো করে গেলেই দর্শকের হৃদয় ছোঁয়া সম্ভব।

আপনি কোনো কোনো সময় পরিচালকের মতের বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে সংলাপ বলেন। আপনার বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগ আছে। আপনি করেন এমন?
বিষয়টি এ রকম নয়। আমি প্রায় ৩৪ বছর ধরে সিনেমায় অভিনয় করছি। আমার একটা অভিজ্ঞতা তো হয়েছেই। শুটিংয়ের সময় মাঝেমধ্যে ইমপ্রোভাইজ করি। কারণ, আমার আত্মবিশ্বাস আছে। কোনো কোনো সময় পরিচালকের মতামতে সংলাপ দিতে গিয়ে মনে হয়, এটি আরেকটু অন্যভাবে দিলে দর্শকের পছন্দ হবে। তবে সেটি পরিচালকের সঙ্গে পরামর্শ করেই করার চেষ্টা করি, চাপিয়ে দিই না। আবার অনেক সময় পরিচালক নিজেও কিছু কিছু জায়গায় সংলাপ আমার মতো করে দিতে বলেন।

দীর্ঘদিন ঢাকার চলচ্চিত্রে নায়ক-খলনায়কের জুটি শাকিব খান ও মিশা সওদাগর। কিন্তু এ সময়ে এসে অনেকেই মনে করছেন, এই জুটির ছবি দর্শক হারাচ্ছে। আপনি কী বলেন?
অনেকাংশে একমত। এ সময়ে এসে আমাদের চরিত্রে যদি নতুনত্ব না আসে, দর্শকের আগ্রহ আরও কমবে। কারণ, দর্শক আমাদের দুজনের এত এত ছবি দেখেছেন যে আমাদের সম্পর্কে দর্শকের একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। দর্শক যদি সিনেমা হলে ঢুকেই বুঝে ফেলেন মিশা এটা করবে, মিশার এটা হবে, আবার শাকিবের এইটা হবে, শাকিব এটা করবে, তাহলে সিনেমার উন্নতি হবে না। এ যুগে এসে দর্শকদের ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে সারা দুনিয়ার সিনেমা দেখছে মানুষ। নায়ক-খলনায়কের চরিত্র দেখছেন। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে দর্শক যেমন এগিয়ে, আমাদের চলচ্চিত্রটাকে দর্শকের মতো এগিয়ে নিতে হবে।

মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত
মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত


এগোতে হলে ভালো গল্প লাগবে। ভালো গল্প হলেই চরিত্রের বৈচিত্র্য আসবে। সেটা তো হচ্ছে না। তাহলে?
আমি সব সময়ই বলি, সিনেমাতে এখন গল্পই নায়ক। ভালো গল্প দিলে ভালো কাজও বেরোবে। ‘আয়নাবাজি’ ছবিতে পরিচালক নতুন, চঞ্চল চৌধুরী ছোট পর্দা থেকে আসা। কিন্তু গল্পের কারণে চরিত্রগুলো ফুটে উঠেছে। আবার ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘স্বপ্নজাল’ ছবিগুলোতেও গল্পের সঙ্গে চরিত্রগুলো কত সুন্দর এগিয়েছে। গল্প ভালো হলে, অনেক সময় কাস্টিং ভেল্যু ছাড়াই ছবি হিট হয়ে যায়।

একসময় চিত্রনাট্য লিখেই তারকা হয়েছেন অনেকে। এখনকার সময়ে সেই ধরনের তারকা গল্পকার, কাহিনিকার নেই কেন?
একসময় আহমেদ জামান চৌধুরী, ছটকু আহমেদ, মনিরুজ্জামান, জোসেফ শতাব্দী, কমল সরকার কিংবা কাসেম আলী দুলালরা গল্প লিখতেন, চিত্রনাট্য করতেন। তাঁদের গল্পে ছবি সুপারহিট, বাম্পার হিট হয়েছে। আর এখন? দীর্ঘদিন ধরে ভালো গল্পকার, কাহিনিকার নেই। এ কারণে দর্শকের কথা মাথায় রেখে গল্প ও চিত্রনাট্য আসছে না। এখন যাঁরা গল্প–চিত্রনাট্য লিখছেন, তাঁদের বেশির ভাগই দর্শকের টেস্ট বুঝতে পারছেন না। ফলে গল্পে মুগ্ধ করে দর্শকদের বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সিনেমার দর্শক শেষ হয়ে যায়নি, ভালো গল্প, ভালো নির্মাণের ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের কমতি হয় না। চলচ্চিত্রের এই মন্দার দিনেও সারা বছর দু-একটি ভালো ছবিতে সেই প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

এখন তাহলে ভালো গল্পকার নেই, ভালো গল্প তৈরি হচ্ছে না?
বাণিজ্যিক ছবির জন্য সে রকম গল্পকার নেই। আবদুল্লাহ জহির বাবুসহ হাতে গোনা কয়েকজন বাণিজ্যিক ছবির গল্প লিখছেন। তবে বেশির ভাগ গল্প দর্শককে মাথায় রেখে লেখা হচ্ছে না। গবেষণা করে দর্শকের টেস্ট বুঝতে হবে। সেভাবেই গল্প লিখতে হবে। এখন দরকার নতুন প্রজন্মের গল্পকার-কাহিনিকার; যাঁদের মাথায় সমসাময়িক বিষয়গুলো আছে। তাঁরা যুগের সঙ্গে থেকে কাজ করার চেষ্টা করবেন।

আমাদের সিনেমা তাহলে কোন পথে যাচ্ছে?
সিনেমা এখন অতল গহ্বরে। সিনেমার ডানা ভেঙে গেছে। উড়তে পারছে না। সিনেমাতে আমার বয়স প্রায় ৩৪ বছর। আমি সিনেমার অন্ধকার যুগ দেখতে চাই না। আলো দেখতে চাই। কিন্তু সিনেমার এই অবস্থা থেকে বের হওয়া কঠিন। বছর বছর সিনেমা কমে যাচ্ছে। দর্শক আসছেন না হলে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। ১ হাজার ২০০ সিনেমা হল থেকে এখন হলসংখ্যা ১০০। ভাবা যায়? আসলে আমাদের সিনেমা এখন অনিশ্চিত পথের যাত্রী। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সিনেমার উন্নতির কোনো পথ খোলা দেখছি না।

বিএফডিসিতে একাধিক সংগঠন নানা কাজে সরব। আপনি নিজেও একটি সমিতির সভাপতি। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার-সালিস করা এবং বার্ষিক পিকনিকসহ নানা উৎসব করে সারা বছর সমিতিগুলো উন্মাদনায় থাকে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছেন আপনারা?
আমরা চেষ্টা কম করি না। চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে অনেক দিন ধরেই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে আসছে সমিতিগুলো। কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন উপায় একটাই, তা হলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে একসঙ্গে চলচ্চিত্রের সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষণা করে এগোতে হবে। তা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না।

মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত
মিশা সওদাগর। ছবি: সংগৃহীত


গত কয়েক বছরে আপনারা সমিতির নেতারা তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অসংখ্য মিটিং করেছেন। ‘গুরুত্বপূর্ণ মিটিং’ উল্লেখ করে সেই সব মিটিংয়ের খবর ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। চলচ্চিত্রের জন্য কী এনেছেন?
সত্যি কথা বলতে, মিটিংয়ের ফলাফল শূন্য। মাঝে ৮০টি হলের আধুনিকায়নের জন্য ৫০ কোটি টাকার ওপরে একটি ফান্ড পাস হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা এখন আর পাওয়া যাবে না। সম্ভবত সেটি বাতিল হয়ে গেছে। নতুন আর কোনো খবর নেই।

ফলাফল শূন্যের কথা বলছেন। এর জন্য আপনারা নিজেরাও দায়ী কি না?
কিছুটা তো অবশ্যই। কারণ, আমরা গত তিন বছরে এই শিল্পের সমস্যাগুলো নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারিনি। চলচ্চিত্রসহ বিনোদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক অসুস্থ শিল্পীর জন্য প্রধানমন্ত্রী সরকারিভাবে লাখ লাখ টাকা সাহায্য দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ শিল্পের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন ধরে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, তার চিকিৎসার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। কেবল শিল্পী নয়, শিল্পেরও চিকিৎসা দরকার। আমার বিশ্বাস, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলেই তিনি সমাধান করে দিতেন। কিন্তু আমরা সম্মিলিতভাবে গত তিন বছরে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারিনি।

কেন যেতে পারেননি? নিজেদের মধ্যে কি সমন্বয়ের অভাব?
হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিগত দিনগুলোতে সমিতিগুলোর মধ্যে রেষারেষি ছিল। তারপরও চলচ্চিত্রের স্বার্থে সবাই এক হয়েছেন, থেকেছেন। কিন্তু কয়েক বছরে সবাই কেমন যেন বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক সমিতির বিচার আরেক সমিতি মানছে না। বিচারে আসছেন না। কেউ ভালো কাজ করলে বা ভালো কাজে সুযোগ পেলে আরেকজন শুভকামনা জানাচ্ছেন না। নিজেদের মধ্যে প্রতিহিংসা বাড়ছে। আমি বলতে চাই, চলচ্চিত্র পিছিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।