কেউ কাউকে থামাতে পারে না

মেহ্জাবীন চৌধুরী
মেহ্জাবীন চৌধুরী
>অভিনয়জীবনে সবচেয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছেন মেহ্জাবীন চৌধুরী। তাঁর কথা ভেবে লেখা হচ্ছে নাটক-টেলিছবির চিত্রনাট্য। এই অবস্থানে পৌঁছাতে মেহ্জাবীনকে বছরের পর বছর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ২০০৯ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিনোদনজগতে পা রাখেন তিনি। ২০১০ সাল থেকে নিয়মিত হন অভিনয়ে। সে হিসাবে অভিনয়জীবনের ১০ বছর পূর্ণ করেছেন। নিজের জীবনের গল্পগুলোই লিখেছেন মেহ্জাবীন চৌধুরী। 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন শিল্পীর মূল্যায়ন করতে হয় তাঁর যোগ্যতা ও কাজ দিয়ে। শিল্পী নারী কি পুরুষ, এর ওপর ভিত্তি করে মেধার মূল্যায়ন কখনোই হতে পারে না। আমি যদি মানসম্মত কাজ করার যোগ্যতা রাখি, তাহলে আমার প্রত্যাশিত সম্মানী একটা সময় অবশ্যই পাব। এটা আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমরা হয়তো নানা দেশের নানা ঘটনা শুনতে পাই। নানা রকম পরিস্থিতির কারণে শিল্পীদের হয়তো লিঙ্গ-বর্ণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু দিন শেষে শিল্পীর যোগ্যতা তাঁর পারফরম্যান্স দিয়েই নির্ধারিত হয়। 

এটা বলতেই হয়, বিনোদনজগৎ এখনো পুরুষতান্ত্রিক। তবে কয়েক বছর ধরে আমি নিজে একটা বদলের আভাস পাচ্ছি। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একটানা আমি এই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি। শুরুর দিকে আমি শুটিং সেটে নিজের মতপ্রকাশের যতটা স্বাধীনতা পেতাম, এখন তা আরও বেড়েছে। নির্মাতা, সহশিল্পী থেকে শুরু করে সেটের প্রত্যেক কুশলী আমাকে যতটা গুরুত্ব দেন, শুরুর পরিস্থিতি এমন ছিল না। বদলটা এসেছে ধীরে ধীরে, একটু একটু করে। আমার ধারণা, পুরুষ কিংবা নারী, ইন্ডাস্ট্রিতে এসে কেউই নিজের অবস্থান একেবারে তৈরি অবস্থায় পান না। অবস্থান নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। 

হ্যাঁ, এটা লিখতেই হবে যে আমার শুরুটা হয়েছিল সুন্দরভাবে, দেশের অন্যতম বড় সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে। এর পরের পথটা কিন্তু তৈরি ছিল না। প্রথম দিকে নির্মাতা বা চিত্রনাট্যকারেরা আমাকে ভেবে কখনোই চরিত্র বানাতেন না, চিত্রনাট্য লিখতেন না। আমি তেমনটা প্রত্যাশাও করতাম না। কারণ, নতুন হওয়ায় আমি তাঁদের আস্থার জায়গায় সে সময় তখনো পৌঁছাইনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই ভরসার জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। 

অভিনয়জীবনে আমি আমার সহ-শিল্পীদের কাছ থেকেও দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি। আমরা সমতার প্রজন্ম। একজনকে এগিয়ে যেতে হলে নারী-পুরুষ সবারই সমান সহযোগিতা প্রয়োজন। আমার বেলায়ও তা-ই হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমার পুরুষ সহকর্মীরা আমাকে নারী হিসেবে নয়, সব সময় সহশিল্পী হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। কখনো আমার ওপর প্রভাব খাটাননি। হ্যাঁ, ক্যারিয়ার শুরুর দিকে পুরুষ সহশিল্পীদের তুলনায় সেটে আমার মতপ্রকাশ ও চরিত্রের গুরুত্বের অনুপাতটা ছিল ৩০ শতাংশ। তবে ধীরে ধীরে এই অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। এখন সেটে আমার সহ-অভিনেতার মতোই আমার চরিত্রও সমান গুরুত্ব পায়। মোটকথা, পুরুষনির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতেও এই জায়গা আমি নিজের যোগ্যতায় তৈরি করে নিয়েছি। এ জন্য লম্বা সময় পরিশ্রম করতে হয়েছে, ধৈর্য ধরতে হয়েছে এবং অবশ্যই পেশাদার হতে হয়েছে। আমার বিশ্বাস হলো মেধা আর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে
কেউ কাউকে থামাতে পারে না। কোনো বৈষম্য কারও যোগ্যতা চেপে রাখতে পারে না। 

হ্যাঁ, চলতে গেলে কিছু বাধা তো আসবেই। লক্ষ্যের দিকে যত এগিয়ে যাবে, লোকে হয়তো নানা কিছু বলবে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে মানুষ এখন চাইলেই হুট করে কোনো বিবেচনা ছাড়াই যেকোনো মন্তব্য করে ফেলতে পারে। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে একজন পুরুষকে অতটা বাজে কথা কখনোই শুনতে হয় না, যতটা একজন নারীকে শুনতে হয়। তাঁর পোশাক থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ই আতশী কাঁচ দিয়ে দেখা হয়, প্রতিটি বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা হয়। প্রতিটি মন্তব্যকে তুমি তোমার মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করো। আমি আমার জায়গা আর অভিজ্ঞতা থেকে বলব, সব সময় নিজের সামাজিক-পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলা উচিত এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে সবার ওপরে রেখে নেতিবাচক মন্তব্যের জবাব দেওয়া উচিত।

তাই আমি প্রতিটি কিশোরী ও তরুণীকে, যারা স্বপ্ন দেখে একটা পুরুষতান্ত্রিক ইন্ডাস্ট্রিতে বৈষম্যকে হার মানিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার, তাদের একটা বার্তাই দিতে চাই, বলতে চাই, নিজেকে নিয়ে কাজ করো। তোমার কাজই তোমাকে সমতা এনে দেবে। তোমার পরিশ্রমের সামনে যেন বৈষম্যকারীরাও ছোট হয়ে যায়।