দিতির অদ্বিতীয় জীবন

সোনালি যুগের দাপুটে নায়িকা দিতিকে আজও স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধায়। ছবি: সংগৃহীত
সোনালি যুগের দাপুটে নায়িকা দিতিকে আজও স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধায়। ছবি: সংগৃহীত

ঢালিউডে ছিলেন দিতি নামের এক রোমান্টিক নায়িকা। তাঁর মুখচ্ছবি কি কেবলই একজন রোমান্টিক নায়িকার? রাঙামাটির হ্রদ বা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বাতাসে উড়তে থাকা চুলের অপূর্ব শোভার এক রূপবতীর?

ইলিয়াস কাঞ্চন, সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে অনেকগুলো রোমান্টিক ছবিতে অভিনয় করেছেন দিতি। টেলিভিশন থেকে সিনেমায় যাওয়া আফজাল হোসেনের সঙ্গেও। তিনি অভিনয় করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা প্রসেনজিতের সঙ্গে। রোমান্টিক ছবিতে দিতির ভুবনভোলানো হাসি তখনকার দর্শকেরা এখনো ভোলেননি।

ধরা যাক ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’ কিংবা ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপ্নের রাত’—এর মতো গানে দিতি ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর সব মনন। তাঁর অভিনয়গুণে এ গান দুটি আজ বাংলা রোমান্টিক গান-ভান্ডারের অমূল্য দুটি রত্ন। তাঁর অভিনয়ের কারণেই দর্শকেরা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতেন, ভিড় করতেন প্রেক্ষাগৃহে। তবে দিতির প্রভাব, প্রতিপত্তি তৈরি হয় সামাজিক ছবি থেকে। এ ধারার ছবিতে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সফল। ‘প্রেমের প্রতিদান’, ‘প্রেমের দাবী’, ‘দুই জীবন’ ‘হীরামতি’র চেয়ে অনেক বেশি সফল ‘উসিলা’, ‘কালিয়া’, ‘বেনাম বাদশা’, ‘চরম আঘাত’ ছবিগুলো।

গ্ল্যামারের সঙ্গে অভিনয় দক্ষতাকে মিশিয়ে সফল ছিলেন দিতি। ছবি: সংগৃহীত
গ্ল্যামারের সঙ্গে অভিনয় দক্ষতাকে মিশিয়ে সফল ছিলেন দিতি। ছবি: সংগৃহীত

নব্বই দশকে যখন সামাজিক ছবির বিজয় নিশান উড়ছিল, তখন তার অন্যতম বাহক ছিলেন দিতিও। নানা রকম পারিবারিক সংকটের কাহিনি, সংসার-ষড়যন্ত্রের দুঃখগাথা, প্রেমের সম্পর্কের সামনে সমাজের প্রতিরোধের গল্পে দিতি ছিলেন স্বচ্ছন্দ। সামাজিক ছবিতে তাঁর চাহিদা ছিল। সামাজিক ছবির যেকোনো চরিত্রে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। তাঁর অভিব্যক্তিতে বৈচিত্র্য ছিল, সংলাপ প্রক্ষেপণে ছিল দৃঢ়তা। যে কারণে শত দর্শকে ভর্তি প্রেক্ষাগৃহে তিনি করতালিতে অভিষিক্ত হতেন।

ওই সময়ে সামাজিক ছবি মানুষ বেশি দেখতে পছন্দ করতেন। এ রকম ছবির টিকিট চটজলদি বিক্রি হয়ে যেত। বাণিজ্যিক ছবির আরেকটি ধারা অ্যাকশন, যেখানে রোমান্টিক নায়িকাদের কম পাওয়া যেত। সেখানেও দিতি দেখিয়েছেন সাহস। ‘রোমান্টিক নায়িকা’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেনেও আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন দিতি। আপসহীন পুলিশ অফিসার, প্রতিশোধকামী কন্যা, এ রকম নানা ধরনের অ্যাকশন-চরিত্রে দিতি ছিলেন সাবলীল। পোস্টার হাতে দিতির রুদ্রমূর্তি দর্শকদের চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যেত অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে।

দিতি তাঁর অমায়িক ব্যক্তিত্বের জন্য সিনেমাপাড়ায় জনপ্রিয় ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
দিতি তাঁর অমায়িক ব্যক্তিত্বের জন্য সিনেমাপাড়ায় জনপ্রিয় ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত

গোলা-বারুদ, ঘোড়া-চাবুকের সঙ্গেও দিতির সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘আজকের হাঙ্গামা’, ‘খুনের বদলা’, ‘লেডি ইন্সপেক্টর’, ‘মুক্তি চাই’, এ রকম ছবিগুলোতে দিতির সাফল্যের হার প্রায় শতভাগ। অস্ত্র হাতে দিতির পর্দায় অবতীর্ণ হওয়া মানেই প্রযোজকের পকেট ভারী হওয়া।

রোমান্টিক, সামাজিক, অ্যাকশন ছবিতে দিতি তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি দিয়ে রঙিন করে রেখেছিলেন গোটা নব্বই দশক। যদিও তাঁর আত্মপ্রকাশ আশির দশকের শুরুতে, ১৯৮৪ সালে। এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসেন দিতি। উদয়ন চৌধুরীর ‘ডাক দিয়ে যাই’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। আজমল হুদা মিঠুর ‘আমিই ওস্তাদ’ ছবির মাধ্যমে অভিষেক হয় দিতির। আশির দশকের শেষের দিকে, ১৯৮৭ সালে সুভাষ দত্তের ‘স্বামী-স্ত্রী’ ছবিতে অভিনয় করে দিতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে যান। পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেত্রী হিসেবে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পুরস্কারের ঘোষণাটাও ছিল চমকের। দিতির ধারাবাহিক সাফল্য আশির দশকেই ফুরিয়ে যায়।

পর্দা সঙ্গী ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে সংসারও পেতেছিলেন দিতি। ছবি: সংগৃহীত
পর্দা সঙ্গী ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে সংসারও পেতেছিলেন দিতি। ছবি: সংগৃহীত

নব্বই দশকের শুরুতেই অন্যতম শীর্ষ নায়িকার দাবিদার হিসেবে তাঁর নাম চলে আসে। তখন অবশ্য শুরু হয়ে যায় শাবানা, অঞ্জু, চম্পার প্রতাপ। হঠাৎ করেই সে সময় চলে আসেন মৌসুমী, শাবনূর, পপিরা। নতুনদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি দর্শকদের পরিবর্তিত চাহিদা মেটাতে থাকেন।

শূন্য দশকে ঢালিউডের সিনেমার ভাষা বদলে যায়। এই ভাষার সঙ্গে দিতি খাপ খাওয়াতে পারেননি। সমসাময়িক অনেকের মতো তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবে একই সময়ে বয়সের সঙ্গে মানানসই চরিত্রে তিনি দর্শকদের সামনে আসেন। সিনেমার চেয়েও তাঁর কাছে প্রাধান্য পেতে থাকে টেলিভিশন নাটক।

সিনেমায় আসারও আগে টিভিতেই হয়েছিল দিতির হাতেখড়ি। ‘হিরামন’ সিরিজেই তাঁর সুন্দর মুখশ্রীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন দর্শক। তখন গানের চর্চা করতেন দিতি। অ্যালবামও বের হয়েছিল। গেল দশকে টিভি নাটক প্রযোজনার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কণ্ঠকেও শ্রোতাদের সামনে আবার নিয়ে আসেন দিতি। বের করেন আরও একটি অ্যালবাম।

সোহেল ও দিতি সমসাময়িক। অশান্ত দাম্পত্যে সুখী হননি কেউই। ছবি: সংগৃহীত
সোহেল ও দিতি সমসাময়িক। অশান্ত দাম্পত্যে সুখী হননি কেউই। ছবি: সংগৃহীত

ক্যারিয়ারের বাইরে দিতির জীবন কিন্তু কম বর্ণাঢ্য নয়। নতুন মুখের প্রতিযোগিতায় দিতির সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন সোহেল চৌধুরী। সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে দুজনে একসঙ্গে জীবনের পথও চলতে শুরু করেন। সোহেল-দিতির বিয়ে, অসহিষ্ণু দাম্পত্য, তার জেরে দুজনের ক্যারিয়ারে অস্থিরতা, এসবই সিনেম্যাগাজিনের খোরাক হয়েছিল। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সোহেল চৌধুরীর অকালমৃত্যুতে দিতির প্রমত্ত জীবন কিছুটা শান্ত হয় যেন।

দিতির নিঃসঙ্গ জীবনে তখন আসেন তাঁর পর্দা সঙ্গী ইলিয়াস কাঞ্চন। দীপ্ত ও লামিয়ার মা চেয়েছিলেন সিনেমাকে বিদায় জানিয়ে সংসারে নোঙর করতে। কিন্তু অল্প দিনের সেই সংসার দিতিকে স্থির করতে পারেনি। পর্দার সফল জুটি কাঞ্চন-দিতির ঝুলিতে বাস্তবের সফলতা অধরাই থেকে যায়। তারপর দিতি তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে একলা পথ পাড়ি দিতে থাকেন। পরিবারের জন্য সময় দিয়ে কিছু বাঁচলে শুটিং করতেন তিনি। অল্প ছবি, অল্প নাটক, স্বল্প উপস্থিতি, তারপরও দিতি ছিলেন দীপ্যমান।

কিন্তু চড়াই-উতরাইয়ে জীবনের লম্বা সময় বেহিসেবে খরচ করে ফেলেছিলেন দিতি। ঝড়, ঝাপটা, বজ্রপাত সইতে সইতে কখন যে নিজের ভেতরে তৈরি করে ফেলেছিলেন ক্যানসারের বাসা, তা টের পাননি। শেষে এই রোগের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হয় আজীবন লড়াকু ও সংগ্রামী এক নারীকে।

আজ দিতির চলে যাওয়ার দিন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ না ফেরার দেশে চলে যান দিতি। রেখে যান জনপ্রিয় ছবির ভান্ডার। রেখে যান মাথা উঁচু করে বাঁচার দৃষ্টান্ত। অভিনেত্রী দিতিকে যেমন আরও বহুদিন মনে রাখবেন দর্শকেরা, তেমনি ব্যক্তি দিতিকেও ভুলে যেতে চাইবেন না তাঁর সুহৃদরা। শেষ জীবনে বিছানায় ক্লান্ত দিতিকে নয়, রুপালি পর্দায় বাঁধভাঙা রূপের ঝরনাটিকেই মনে রাখতে চান তাঁর ভক্তরা।