যে সিনেমা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন

‘ওকজা’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘ওকজা’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের ছোট্ট একটি গ্রাম। চাষি মাশত হাসানের ছেলেপুলে নেই। মনটা ভারী থাকে তাই। গ্রামের ছোট রাস্তার মুখে আজ লোকসমাগম। হাসানের মুখেও আনন্দের খেল। সবাই ছুটে আসে হাসানের কাছে। সে যে আজ নতুন করে ঢুকেছে গ্রামে। মলিন মুখে হাসির ছলক। কারণ, সঙ্গে আছে তারই সন্তান।

হাসান যাকে নিয়ে ঘরে ফেরে, সে একটি গাভি। নিঃসন্তান হাসানের গাভটিই এখন সব, ছেলে কিংবা মেয়ে। হাসান ঘরে ঘুমায় না, ঘুমায় গাভিটির সঙ্গে গোয়ালঘরে। গাভি যখন খড় খায়, হাসান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ঠিক যেমনটি বাবা সন্তানের খাবার পানে তাকিয়ে থাকে। হাসান গাভিটিকে আদর করে দেয়, গাভিটির সঙ্গে কথা বলে। ধীরে ধীরে সন্তানের জায়গায় স্থান করে নেয় এই গাভি। হাসানের স্ত্রী সন্তানের কথা বলে। হাসান দেখিয়ে দেয় গাভিকে, এই মুহূর্তে সে–ই তাদের একমাত্র সন্তান। হাসানের আচরণে স্ত্রী, গ্রামবাসী অবাক হয়। তাতে সম্পর্কে একটুও চিড় ধরে না হাসান ও গাভির। একদিন গাভিটি গর্ভধারণ করে। হাসানের খুশি যেন আর ধরে না।

কী এক কাজে হাসান চলে যায় গ্রামের বাইরে। বেশ কদিনের জন্য। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সকালবেলা সবাই দেখে গাভিটি মারা গেছে। চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। হাসান এলে তাকে এ কথা কেমন করে বলবে? অবশেষে বুদ্ধি বের হয়, কবর দেওয়া হবে গাভিটি। হাসানকে বলা হবে, চলে গেছে সে, যেদিকে চোখ যায়।

‘গাভ’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘গাভ’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

কাজ শেষে হাসান ফেরে। খাঁ খাঁ করছে গোয়ালঘর। সেখানে নেই হাসানের সন্তান। সবাই পরিকল্পিত সেই মিথ্যা গল্পটি বলে হাসানকে। হাসান মানে না। সে পাগলের মতো হয়ে যায়। ঘুমায় গোয়ালঘরেই। খাওয়াদাওয়া বন্ধ। একদিন সবাই দেখে, হাসান খড় খাওয়া শুরু করেছে। হাসান নিজেই যেন হয়ে উঠছে সেই গাভি!

ইরানি ছবি ‘গাভ’–এর গল্পকে ছোট করে বললে এমনটি দাঁড়ায়। কিন্তু পরিচালক দারউইশ মেহেরজুই এই ছোট গল্পে যে বিশাল অর্থ এঁকেছেন, তা এই সময়ে এসেও যেন হাজির। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দিকটি নিয়ে আজও সারা বিশ্ব প্রশ্নের মুখোমুখি।

বলে রাখি, মেহেরজুই সেই সব নির্মাতার অগ্রপথিক, যাঁরা ইরানের নবতরঙ্গ আন্দোলনের পরিচিত মুখ। আব্বাস কিয়ারোস্তামি, মোহসেন মাখমালবাফ, জাফর পানাহি, মাজিদ মাজিদি, আসগর ফরহাদি, বহমান ঘোবাদি কিংবা সদ্য স্বর্ণভালুক বিজয়ী মোহাম্মদ রসৌলফদের তিনি পূর্বসূরি। ‘গাভ’ ছবিটি মেহেরজুইয়ের দ্বিতীয় সিনেমা। সিনেমাটিকে ইরানের নবতরঙ্গ আন্দোলনের প্রথম সিনেমা হিসেবে ধরা হয়।

‘ওল্ড পার্টনার’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘ওল্ড পার্টনার’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন জাগতেই পারে, হঠাৎ ১৯৬৯ সালের সিনেমা নিয়ে এত কথা কেন? তার উত্তরে বলি, ‘গাভ’ ছবি দিয়ে প্রকৃতি কিংবা প্রাণীর সঙ্গে মানুষের যে মেলবন্ধন মেহেরজুই দেখিয়েছিলেন, তা আজও দরকারি। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মানুষ অবরুদ্ধ করেছে নিজেকেই। আর প্রকৃতি মেলে দিয়েছে তার অপার ডানা। ইতালির লেকগুলোতে দূষণ কমছে। সেখানে আবার চলে এসেছে মাছ। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নেই পর্যটক। ডলফিন শুরু করেছে জলকেলি। মাত্র কদিনের পরিবর্তনে প্রকৃতি মুখ খুলেছে। বলছে, তারা চায় বন্ধুতা। আর আমরা দূষণে, বর্জ্যে, খামখেয়ালি জীবনাচরণে প্রকৃতিকে করেছি অতিষ্ঠ। বলে রাখা ভালো, করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যে চীনে, পৃথিবীর দূষণ কার্যক্রমে তারা বরাবরই প্রথম কাতারে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অবরুদ্ধ আমরা। সময় যেন কাটছে না। আমাদের সঙ্গী হতে পারে এই সিনেমাগুলো, যেগুলো মনে করিয়ে দেবে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মেলবন্ধন, আচরণ। শেষ করার আগে আরও একটি ছবির কথা বলে যেতে চাই। প্রাণীর সঙ্গে কাল্পনিক এই দৃশ্যকল্প দারউইশ মেহেরজুই এঁকেছিলেন ১৯৬৯ সালে ‘গাভ’ ছবি দিয়ে। তার ঠিক ৩৯ বছর পরে প্রাণী ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্রই বানিয়ে ফেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রকার সং রুল লি। ‘ওল্ড পার্টনার’ নামের ওই ছবিতে ৪০ বছরের একটি বয়স্ক গরুর সঙ্গে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধের জীবনযাত্রা বয়ান করা হয়েছে। সং ওই ছবিতে বৃদ্ধ কৃষক চোয়ি উন কিউনের জীবনযাত্রা সমান্তরালভাবে একটি বয়স্ক বলদের সঙ্গে দেখিয়েছেন। দুজন দুটি আলাদা প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব, জীবনের চলার পথে একে অপরের প্রয়োজনীয়তা পরিচালক সং এঁকেছেন কাব্যিক তুলিতে।

‘জালিকাট্টু’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘জালিকাট্টু’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

সংয়ের গোড়ার দিককার ছবি এটি। বক্স অফিস ও উৎসব—দুই জায়গাতেই ছবিটি এতটাই সফল যে বিশ্বের সেরা প্রামাণ্যচিত্রগুলোর সঙ্গেও নবীন এই চলচ্চিত্রকারের প্রামাণ্যচিত্রটি স্থান লাভ করে। এই সফলতা, এই কাব্যিক দৃশ্যকাব্যের পেছনে একটা গল্পই দাঁড়িয়ে যায়, তা হলো মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক।

ছবিটি আপনার চলচ্চিত্রের ক্যালেন্ডারে যোগ না হয়ে থাকলে দেরি করবেন না। সপ্তাহের একটা দিনে লেখা থাকুক ‘ওল্ড পার্টনার’। এই দুটি ছবি দেখার পরে নিশ্চয়ই এ ধরনের আরও ছবি খুঁজতে গুগল করবেন। বলে রাখি, গুগল করার আগে দেখে নিন আরও দুটি ছবি। দক্ষিণ ভারতীয় ছবি ‘জালিকাট্টু’ আর দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি ‘ওকজা’ আপনাকে নতুন প্রশ্নও জাগ্রত করাবে।