সাহায্য করে লোক দেখানোর কিছু নেই

মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো
মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো

গানের জগতের সবাই এখন ঘরে সময় কাটাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ আছে স্টুডিওগুলো। তবে ঘরে বসে গান করছেন তাঁরা। ফেসবুক, ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামে সেসব প্রকাশ করছেন। গত রোববার হঠাৎ ফেসবুকে শিল্পী মমতাজের একটি ছবি পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি স্টুডিওর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে। সম্প্রতি তিনি কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

রেকর্ডিং স্টুডিওর মাইক্রোফোনের সামনে একটা ছবি দেখলাম।
গান গাইছিলাম। নতুন একটি গান।

নিশ্চয়ই করোনাভাইরাস সচেতনতা নিয়ে গান?
ঠিক তা–ই। করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য গানটি তৈরি করা হয়েছে। ‘বুকটা ফাইট্টা যায়’ গানের সুরে গানটি তৈরি। ‘নিয়মটা মাইনা যায়’ এমন কথায় গানের সংগীতায়োজন করেছেন লাবিক কামাল গৌরব।

সবাই যেখানে গৃহবন্দী, আপনি স্টুডিওতে গিয়ে গাইলেন?
দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে বন্দী সময় কাটছে। এর মধ্যে গানটি নিয়ে পরিকল্পনা হয়। কীভাবে গানটি রেকর্ডিং হবে, তা নিয়ে ভাবছিলাম। গৌরব একবার বলেছিল, ঘরে বসে রেকর্ডিং করতে। কিন্তু আমার মনে হলো, তাতে সাউন্ড কোয়ালিটি ভালো হবে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহাখালী ডিওএইচএসের বাড়ি থেকে গুলশানের স্টুডিওতে গিয়ে কণ্ঠ দিলাম। খুব সাবধানে, সব ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়েই ঘর থেকে বের হয়েছি।

আপনি একজন সাংসদ। এই সময়ে নিজের নির্বাচনী এলাকার জন্য কী করছেন?
আমার এলাকায় অসহায় ও অসচ্ছলদের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রশাসন মারফত সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে সচেতন থাকতে বলা হচ্ছে। আমি যেতে পারছি না। কারণ, আমি গেলেই অনেক লোক জড়ো হয়ে যায়। সবাই কোনো না কোনোভাবে দেখা করতে চায়, কথা বলতে চায়, কাছে আসতে চায়। এই সময়ে যেহেতু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে জোর দেওয়া হচ্ছে, তাই যেতে পারছি না। প্রশাসনের বাইরে আমার সংগঠনের তরুণেরাও সবার পাশে থাকার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?
আমরা তো ছোট দেশ, বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছে। পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেছে। তারপরও সবাই এই ভাইরাস প্রতিরোধের চেষ্টা করে যাচ্ছে। টানা অনেক দিন ঘরে বসে থাকার কারণে কত কিছু যে মাথায় আসছে। যা কখনো ভাবতে চাইনি, মনের মধ্যে সেসবও উঁকি দিচ্ছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি এই সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠব। এরপর সুন্দর একটা পৃথিবী পাব।

মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো
মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো

অনেকে বলছেন, প্রকৃতি তার মতো করে পৃথিবীকে সাজিয়ে নিচ্ছে। আপনারও কি তা–ই মনে হয়?
আকাশ ও সমুদ্রের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, সত্যিই প্রকৃতি তাঁর মতো করে পৃথিবীকে সাজিয়ে নিচ্ছে। আমাদের ঘরে বন্দী করে পৃথিবী তার মতো করে নিজেকে গোছাচ্ছে। আমরা যাতে পরিবেশ দূষণ না করি, নিজেদের দূষণ না করি, সেই শিক্ষাও দিয়ে দিচ্ছে। আমরা যে পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম, করোনা আমাদের একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। এই সময়টা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সৃষ্টিকর্তা আমাদের দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার সুযোগ দিলে দেশের প্রতি, পরিবেশের প্রতি সবাইকে সৎভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়টার কাছ থেকে আমাদের কী কী শেখা উচিত?
করোনা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে মানবিক হওয়ার, ভালোবাসা ছড়ানোর। এই যে ঘরবন্দী সময় পার করছি, কত কত মানুষের সঙ্গে যে কথা হচ্ছে, যাদের সঙ্গে বহু বছর ধরে আমাদের দেখা তো দূরে থাক, কথা বলারও সময় ছিল না। আমরা মেশিনের মতো চলছিলাম। কিসের পেছনে যে ছুটছিলাম... হুট করে আমাদের থামিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। মানুষকে নিয়ে মানুষকে ভাবতে শেখাচ্ছে। যে যে ধর্মেরই হই না কেন, একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তাঁর প্রতি আমাদের অগাধ বিশ্বাস থাকা উচিত, সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তা চাইলে তাঁর সৃষ্টিকে যেভাবে খুশি সাজিয়ে নিতে পারেন, সেটা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমার এ–ও মনে হয়, আমাদের মঙ্গলের জন্যই হয়তো এমনটা ঘটছে।

করোনা মহামারির পর আপনার প্রত্যাশা কী?
পৃথিবীটা সুন্দর হোক। নিজের দেশটার প্রতি আমরা যেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা রাখি। মন থেকে ভালোবাসা বাড়াতে হবে, হিংসা কমাতে হবে। মৃত্যুই একমাত্র সত্যি, এটা যেন মনে রাখি। কখন কার দরজায় মৃত্যু এসে কড়া নাড়বে, কেউ জানি না। কিন্তু এমন মৃত্যু চাই না, যাতে মরদেহ নিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।

দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে কী কী করলেন?
এত কাজ করেছি যে সন্তানদের সময় দিতে পারিনি। এখন তাদের সঙ্গেই সময় কাটছে। মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না, তারা সবাই নিত্যনতুন রান্না করছে। আমাকে দিয়ে সেসব খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করাচ্ছে। সময়টা একেবারে খারাপ যাচ্ছে না। তবে যে পরিস্থিতি, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তাও হচ্ছে।

আপনি নিজে রান্না করছেন না?
আমি রান্নাবান্নায় অতটা ভালো না। বলতে পারেন, রান্না করতে পারি না।

মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো
মমতাজ। ছবি-প্রথম আলো

একজন সাংসদ হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাই, করোনাভাইরাসের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
সত্যি বলতে, সারা পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করতে গেলে তো আমাদের প্রস্তুতি আসলে কিছুই নয়। আমরা খুবই নগণ্য। সৃষ্টিকর্তার দয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। বাইরের দেশগুলোতে যখন করোনা সংক্রমণের খবর শুনেছি, যতটা সময় পেয়েছি, তাতে আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল। সৃষ্টিকর্তা না করুক, যদি করোনা সংক্রমণ ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনের মতো আকার ধারণ করে, আমরা যত গল্পই করি না কেন, আমাদের অবস্থা খারাপ হবে, ভয়াবহ হবে—এটা স্বীকার করতেই হবে।

আমাদের দেশের মানুষেরা কতটা সচেতন?
আমি আমার গানে গানে সচেতন হওয়ার আহ্বান করছি। আমরা প্রতিনিয়ত প্রশাসনের লোকেদের, ডাক্তারদের দোষ ধরি। অথচ এই সময়টাতে তাঁরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। তবে এটাও ঠিক, কাজ করতে গেলে ভুল হয়, ভুল সংশোধনের সুযোগও দেওয়া উচিত। আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদিনই খোঁজ নিচ্ছি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সবাই প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। পুলিশদের জন্য নিজ উদ্যোগে পিপিই কিনেছি। এদিকে ঘরে থাকতে অনেকেরই কষ্ট হচ্ছে। সময় কাটছে না। কিন্তু তারপরও আর কয়েকটা দিন যেন আমরা ঘরে থাকি। বাঙালিদের স্বভাব আড্ডা দেওয়া, গল্প করা। এসব থেকে এক-দুই সপ্তাহ বিরত থাকি। নিজে ভালো থাকি, অন্যদের ভালো থাকতে সাহায্য করি। যাদের খাবারের অভাব আছে, আমরা খেয়াল রাখছি। অন্যরা সবাই যেন তার পাশের মানুষের দিকেও খেয়াল রাখে। আমরা কেউ যেন ঘরের বাইরে ডেকে এনে লোক দেখিয়ে সহযোগিতা না করি। যাদের সহযোগিতা করতে চাই, ঘরে গিয়ে নীরবে যেন সেরে আসি।

কেউ কেউ সহযোগিতার বিষয়টি ফেসবুকে সরাসরি প্রচার করে।
সহযোগিতা করা নিয়ে লোক দেখানো বেশি হয়ে যাচ্ছে। সাহায্য করে লোক দেখানোর কিছু নেই। সহযোগিতা করলে সবাই যেন মন থেকে করি।

গানের জগতের মানুষেরা কেমন আছেন?
গানের জগতের মানুষেরা কবে যে ঘর থেকে বের হতে পারবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গানের জগৎ কবে ঘুরে দাঁড়াবে, এটা নিয়ে ভাবতে হবে। সবাই এক হয়ে সবার পাশে কীভাবে দাঁড়ানো যায়, সেটাও ভাবা দরকার। আমার অনেকগুলো অনুষ্ঠান ছিল। করোনায় সবকিছু পিছিয়ে গেছে। আমাদের প্রধান আয় তো গান থেকে।