এখনকার নায়িকারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে আসে

>করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তিন সপ্তাহ ঘরবন্দী চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা। মেয়ের পড়াশোনা দেখভাল করার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ভাবছেন করোনা–পরবর্তী সময়ে নিজের দেশ ও পৃথিবী নিয়ে।
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়টায় সারা দিন ঘরে থাকা মানুষগুলোর অনেক রকম উপলব্ধি হচ্ছে। আপনারও কি তেমন কোনো উপলব্ধি হচ্ছে?
জীবনে বেঁচে থাকার জন্য কোটি কোটি টাকা থেকে কোনো লাভ নেই। আবার যাঁরা একেবারে খেটে খাওয়া মানুষ, দিন আনে দিন খায়—তাঁদের যে কি কষ্ট। কোনো শ্রেণির মানুষই করোনাভাইরাসে কিছু করতে পারছে না। যাঁরা বিত্তবান, তাঁরা হয়তো নিরাপদ জীবন যাপন করছেন। তিনবেলা খাওয়ার চিন্তাও নেই। কিন্তু যাঁরা দিন আনে দিন খায়, তাঁরা কীভাবে চলবেন! কত দিনই বা এই পরিস্থিতি চলবে। কোয়ারেন্টিন, করোনাভাইরাস কী—এসব নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের মাথাব্যথা নেই। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, এটা আবার কিসের ভাইরাস। ঘর থেকে বাইরে যাব না কেন। তাঁদের কাছে করোনার চেয়ে পেটের ক্ষুধা ভয়ংকর। করোনাভাইরাস পৃথিবীকে যেভাবে দেখাচ্ছে, এমন অন্যভাবে দেখেছি, কিন্তু বাস্তবে দেখতে হবে কখনো ভাবিনি!

অন্যভাবে কোথায় দেখেছেন?
সিনেমায় দেখতাম, জোম্বি, মনস্টার আসছে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে এম পৃথিবী দেখতে হবে কল্পনাও করিনি। পুরো পৃথিবী লকডাউন, ভাবা যায়! এসব ভাবাচ্ছে। ভয়ও পাচ্ছি। ভবিষ্যৎ যে কোথায়...। সবাই মেশিনের মতো দৌড়াচ্ছিল। কাজ করছিল। ঢাকায় এবং দেশের বাইরে যে ব্যস্ত সড়কগুলো দেখতাম—সেগুলো এখন ফাঁকা, নীরব। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালির যেসব সড়কে মানুষ আর মানুষ, সেসব এখন খাঁ খাঁ...শূন্য। আমি এই মুহূর্তে আমাকে ছাড়া বাকি পৃথিবীর সবার কথা ভাবছি। সবার কথা ভাবছি। অর্থনৈতিক অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভাবাচ্ছে। তিন মাস পরের অবস্থা ভেবে সবচেয়ে আপসেট হচ্ছি। আবার নিজেকে নিজেকে নিজে ঠিক সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছি।

পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

দিনের পুরোটা সময় তো বাসায়। কী করেন?
এভাবে কখনো থাকিনি। দু-তিন দিন পর ঠিকই বের হয়েছি। কাজ না থাকলে তখন ঘর থেকে বের হতাম না জ্যামের ভয়ে। ভাবতাম, বাসা থেকে বের হয়ে দুই ঘণ্টা রাস্তায় কেন বসে থাকব। এরপরও বাচ্চার খেলনা কিনতে বা বাসার প্রয়োজনীয় বাজার করতে কিংবা খেতে বের হতাম। এখন তো রেস্টুরেন্টও বন্ধ। এখন বাইরে যেতেই ভয় লাগে, কোথা থেকে আবার কী ছড়ায়! বাসায় থেকে মেয়ের স্কুলের পড়া দেখছি। অনলাইনে মেয়ের ক্লাস চলছে। মেয়ের সঙ্গে আমারও পড়াশোনা হচ্ছে। এসব করতেই তিন-চার ঘণ্টা কেটে যায়। এরপর নেটফ্লিক্স আর ইউটিউবে সিনেমা দেখি। আগে খবর দেখতাম। এখন খবর দেখলে ভয়ই লাগে। তবে আপডেট থাকি।

কোন ধরনের সিনেমা দেখছেন?
হাসির সিনেমা দেখছি। কারণ, হাসির সিনেমায় মন প্রফুল্ল থাকে। আমি শহীদুল ইসলাম খোকন ভাইয়ের ‘ভণ্ড’ আর ‘পালাবি কোথায়’ ছবি দুটির ফ্যান। হ‌ুমায়ুন ফরীদি আর এ টি এম শামসুজ্জামানের জন্যই ‘ভণ্ড’ ছবিটি বেশি ভালো লাগে। একটু কমেডি, হাসি, ফাইট—সবই আছে। এই ছবি দুটি আরও কয়েকবার দেখেছি। হিন্দি আর ইংরেজি ছবির কথা না-ই বা বললাম। 

পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

‘ভণ্ড’ যেদিন মুক্তি পায়, একই দিনে আপনার প্রথম সিনেমা ‘এ জীবন তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। যতটা জানি, আপনার ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে কিছুটা মার খেয়েছিল।
কিছুটা না, ভালোই মার খেয়েছিল ‘ভণ্ড’র জন্য। সেদিন আমি আমার ছবি না দেখে শুরুতে অভিসারে ‘ভণ্ড’ দেখতে গিয়েছিলাম। মধুমিতায় চলছিল ‘এ জীবন তোমার আমার’। আমার ছবির দর্শক ছিল কম। ‘ভণ্ড’ ছবির নায়িকা তামান্নারও সেটি ছিল প্রথম সিনেমা। প্রথম দিকে যখন চিন্তা করতাম, খারাপ লাগত এই ভেবে যে একই সঙ্গে আমাদের দুজনকে দুজন পরিচালক দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, অথচ তামান্নার ছবি সফলতা পেল, আমারটা পেল না। ওসব এখন অবশ্য ভুলে গেছি। করোনার দিনে ‘ভণ্ড’ আবার দেখছি, কারণ হাসতে হবে। আর আমার ছবি দেখলে মন খারাপ হবে এই ভেবে, কী করেছিলাম অভিনয়! প্রথম ছবির কাজ করার সময় অবশ্য অভিনয়ের অ জানতাম না। রোদে রেখে কাঁঠাল যেভাবে পাকায়, আমাকে সেভাবে তৈরি করেছিল। আমাকে রীতিমতো কিলিয়ে অভিনয় শেখানো হয়েছিল। সেসব এখন মনে হলে লজ্জাই লাগে।

কবে বুঝতে পেরেছিলেন যে অভিনয়ের কিছু বুঝতে পেরেছেন?
আমি যে কিছু বুঝি, এটা বুঝতেই আমার ১৫ বছর সময় লেগেছিল। (হাসি)

পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

এত লম্বা সময় লাগল?
আমি আসলে বুঝতেই চাইনি। আমি শুধু ক্যামেরা, কাট, অ্যাকশন শুনেছি আর অ্যাক্টিং করে আসছি।

কবে থেকে অভিনয় করা বিষয়টি উপলব্ধিতে এনে দিয়েছিল?
পরের দিকে ইতিহাসনির্ভর গল্পের কাজ যখন শুরু করলাম, তখন থেকে বুঝতে শিখি। এর আগে অবশ্য অভিনয় নিয়ে শুটিংয়ের মানুষ আমাকে অনেক বেশি কথা শোনাত। আমি তো বলব, এখনকার নায়িকারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে আসেন। আমরা ওরকমভাবে আসিনি। আমাদের সময়ে ড্যান্স ডিরেক্টর কিংবা ডিরেক্টর—যে-ই হোক, মুখের ওপর বলে দিতেন, তুমি তো শাবনূরের নখের যোগ্যও নয়। মৌসুমীরও যোগ্য নয়। শাবনূর আপুর নাম সবচেয়ে বেশি মেনশন করে বলতেন। কী করো, কোনো এক্সপ্রেশন নেই। তুমি তো একটা পাথর, কী এক মূর্তি নিয়ে আসছি—এ ধরনের অনেক কথা শোনাতেন। আমিও এক কান দিয়ে ঢোকাতাম, আরেক কান দিয়ে বের করে দিতাম। মাঝেমধ্যে এত খারাপ লাগত যে কান্নাও করে দিতাম।

পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

কেউ কি আপনাকে এক্সপ্রেশন ধরিয়ে দিয়েছিল?
মনে মনে ভাবতাম, আমার আসলে সমস্যা কী? চোখ নড়ে না, মুখ নড়ে না—কী নড়ে আসলে আমার! (হাসি)। ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘সুভা’, ‘শাস্তি’ চাষী নজরুলের ইসলামের এই ছবিগুলোর কাজ করতে দিয়ে তিনি হাতে ধরে শিখিয়েছেন। তিনি আমাকে বলতেন, এভাবে এক্সপ্রেশন দে, ওভাবে দে। তোর অভিনয় করতে হবে না, অভিনয়ই তুই ভুলে যা। তখন আমার মাথায় এল, আমার আসলে অভিনয় ভুলতে হবে। আমাকে চরিত্র হতে হবে। এরপর থেকে ন্যাচারাল হওয়ার চেষ্টা করেছি, এক্সপ্রেশন বিষয়টিও বুঝেছি। চাষী নজরুল ইসলামের এই ছবিগুলো আমার সেই ভিত তৈরি করে দিয়েছিল।

কিন্তু এর আগে ‘মনের মাঝে তুমি’ ছবিতেও তো আপনাকে সাবলীল মনে হয়েছে...
এটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। বলতে গেলে, যা নিজেকে সাবলীল রাখার চেষ্টা করেছি। সামহাউ ওটাতে ভালো হয়ে গেছে। দর্শকেরও ভালো লেগে গেছে। এখন দেখলে মনে হয়, আমি আরেকটু ভালো করতে পারতাম। পরে আবার চিন্তা করি, ওই সময়ের জন্য ওটাই বেস্ট ছিল। এখন করলে অতিরিক্ত পাকনামি করতাম। (হাসি)

পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে
পূর্ণিমা। ছবি: ফেসবুক থেকে

নিজে থেকে কি কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন?
সত্যি কথা বলতে, তখন আমাকে যার কথাই বলা হতো, তারই অভিনয় দেখতাম। চোখ কীভাবে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করলাম। চোখ দিয়ে সাইলেন্স এক্সপ্রেশন কীভাবে দিতে হতো। ঠোঁট কীভাবে কাঁপাতে হতো। কীভাবে অনুভূতি আনতে হয়—এসব গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করলাম। টিভি ছেড়ে ছেড়ে এসব কপি করা শুরু করি। এরপর থেকে আমি অনেক অভিনয়শিল্পীকে কপি করা শুরু করেছি। ববিতা আপা, শাবানা আপা, কবরী আপা, রুনা লায়লা আপা, মৌসুমী আপা, শাবনূর—তাঁদের সবাইকে তখনই কপি করা শুরু করি। (হাসি)

‘গাঙচিল’ ছবির কাজ কী এখনো শেষ হয়নি?
অল্প কিছু কাজ বাকি আছে। মার্চে শুটিং করার কথা ছিল। কিন্তু করোনা সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে।