আজও দিব্যা ভারতীর মৃত্যু রহস্যঘেরা

সে সময়ের দর্শকদের ভুলে যাওয়া কঠিন এই চেহারা, হাসি। ছবি: ফেসবুক থেকে
সে সময়ের দর্শকদের ভুলে যাওয়া কঠিন এই চেহারা, হাসি। ছবি: ফেসবুক থেকে

নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা। ঈদ, বৈশাখসহ নানা সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশে আনাচে কানাচে মেলা বসতো। অনেকটা এখনকার মতো মেলা। তবে একটা ভিন্ন চেহারা ছিল। সে সময়ের প্রতিটি মেলায় বড় বড় পোস্টার বিক্রি হতো। শুধু মেলায় নয়, শহরের নানা জায়গায় পোস্টারের দোকান থাকত। সেসব পোস্টারের দোকানে একজন বলিউড তারকার মুখচ্ছবি দেখা যেত, তিনি দিব্যা ভারতী। মিলত দিব্যার নানা রকমের ভিউকার্ড। মিষ্টি হাসির গোলগাল মুখাবয়ব। চাউনিতেই যেন প্রেম। সে সময়ের দর্শকদের ভুলে যাওয়া কঠিন এই চেহারা, হাসি। যেমন মুখশ্রী, তেমনিই অভিনয়।

কী, স্মৃতির কপাটে কড়া নড়ল? অনেকের স্মৃতিতে হয়তো জোরেশোরেই ধাক্কা পড়েছে। আসলে ভিসিআর আর পোস্টারের সে যুগে বলিউডে নারী তারকার নতুন ভাষা ছিলেন দিব্যা ভারতী৷ তিনি যেন ছিলেন অভিমানে না ফোটা ফুল। ক্যারিয়ার যখন ঊর্ধ্বে, ঠিক তখনই আসে মৃত্যুর ডাক৷ ১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল, ভারত তো বটেই, বাংলাদেশে অনেক দর্শককে চমকে দিলেন দিব্যা! মাত্র ১৯ বছর বয়সেই চলে গেলেন তিনি। আজকের সেই দিনে। সবাই জানেন মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয় নিছক দুর্ঘটনা কিন্তু ওই মৃত্যু আজও বহু মানুষের কাছেই রহস্য।

কেটে গেছে ২৭ বছর। অথচ আজও কি স্পষ্ট দিব্যার নামটি। সকাল থেকে ফেসবুক, টুইটারে দিব্যাকে দেখা যাচ্ছে। সেই চেনা হাসিতে। ভাবলে অবাক লাগে, এত বছর পরেও স্থায়ী তাঁর নামটি। অথচ তাঁর অভিনয় জীবন ছিল মাত্র তিন বছরের। এর মধ্যেই দিব্যার ভারতে বিপুল জনপ্রিয়তা অনেক বলিউড নায়িকার কাছেই ছিল ঈর্ষণীয়।

দিব্যার জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ফেসবুক
দিব্যার জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ফেসবুক

দিব্যার জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা ওমপ্রকাশ ভারতী ছিলেন জীবন বীমাকর্মী। মা মিতা ভারতী গৃহিণী। ছোট ভাই কুনাল এবং সৎ বোন পুনমের সঙ্গে মুম্বাইয়ে বেড়ে ওঠা দিব্যার। ছোট থেকেই হিন্দি, মারাঠি আর ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন। পড়তেন মানেকজি কুপার হাইস্কুলে। তবে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার পরে নবম শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা করেননি তিনি।

১৯৮৮ সালে ‘গুনাহো কা দেবতা’ ছবিতে দিব্যার অভিনয়ের কথা হয়েছিল। কিন্তু শেষ অবধি তিনি বাদ পড়েন। কীর্তি কুমার তাঁকে বেছে ছিলেন ‘রাধা কা সঙ্গম’ ছবির জন্য। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেই সুযোগ চলে যায় জুহি চাওলার কাছে।

মিষ্টি হাসির গোলগাল মুখাবয়ব দিব্যার। ছবি: ফেসবুক থেকে।
মিষ্টি হাসির গোলগাল মুখাবয়ব দিব্যার। ছবি: ফেসবুক থেকে।

বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন দিব্যা। কিছুটা নিজের অনিচ্ছায় তিনি শুরু করেন তেলুগু ছবি ‘বব্বিলি রাজা’র শুটিং। ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বব্বিলি রাজা’ এখন অবধি সফলতম তেলেগু ছবির মধ্যে অন্যতম। প্রথম ছবিতেই আকাশছোঁয়া সাফল্যের পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি দিব্যাকে। প্রথম দুই বছর তেলেগু ও তামিল ছবিতে অভিনয়ের পরে হিন্দি ছবির জগতে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে। ১৯৯২ সালটি ছিল হিন্দি ছবিতে দিব্যা ভারতীর বছর। ওই একটি বছরে দিব্যা অভিনীত ১২টি ছবি মুক্তি পায়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে সময়ে দিব্যা ভারতীর পর্দার উপস্থিতি এতটাই আবেদনময় ছিল দর্শকের কাছে যে, এই অষ্টাদশী নায়িকাকে দিয়ে ছবি সাক্ষর করাতে প্রযোজকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। শোনা যায়, ১৯৯২ সালেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াদওয়ালার। ভারসোভার তুলসী অ্যাপার্টমেন্টে নাদিয়াদওয়ালাদের ফ্ল্যাটেই গোপনে বিয়ে করেন দুজনে। এখনকার মতো সেই সময়েও নায়িকা বিবাহিত হলে দর্শকের কাছে তাঁর আবেদন কমে যায় বলে মনে করা হতো। তাই বিয়ের বিষয়টি একেবারেই গোপন রাখা হয়। বলিউডের অন্দরে তখন সাজিদ নাদিয়াদওয়ালা ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে ঈর্ষণীয় মানুষ, যিনি খুব অল্পদিনের আলাপেই সারা দেশের মানুষের হার্টথ্রবের মন জয় করেছিলেন।

শাহরুখের সঙ্গে অল্পদিনেই জুটি তৈরি হয়েছিল। ছবি: ফেসবুক
শাহরুখের সঙ্গে অল্পদিনেই জুটি তৈরি হয়েছিল। ছবি: ফেসবুক

কিন্তু আফসোস, মাত্র এক বছরও টিকল না এই দাম্পত্য। ১০ মে দিব্যা-সাজিদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীর এক মাস আগেই চলে গেলেন দিব্যা। দিব্যার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায়। সেই সময়ে দিব্যা-সাজিদের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন ডিজাইনার নীতা লুল্লা, তাঁর স্বামী এবং দিব্যার নিজস্ব কর্মচারী। শোনা যায়, পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটের জানলা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন দিব্যা। নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

অনেকে এর পর নানা তত্ত্ব নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। কেউ বলেন তাঁর মৃত্যু আসলে পরিকল্পিত খুন, কেউ বলেন দিব্যা সেই সময় মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন ইত্যাদি। ১৯৯৮ সালে অনেক তদন্তের পরে মুম্বাই পুলিশ এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে ফাইলটি বন্ধ করে দেয়। তবে ভক্তদের ভাবনার ফাইল বন্ধ হয়নি। তাদের কাছে এখনো দিব্যা ভারতীর মৃত্যু রহস্যে ঘেরা। সত্যিই কী তিনি বেসামাল হয়ে বারান্দার রেলিং থেকে পড়ে গিয়েছিলেন নিচে? নাকি কেউ তাঁকে ধাক্কা দিয়েছিল?

বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন দিব্যা। ছবি: ফেসবুক
বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন দিব্যা। ছবি: ফেসবুক

তাঁর মৃত্যুর সময় অন্তত ৫-৬টি ছবি অসমাপ্ত ছিল। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রযোজকদের নতুন নায়িকাদের নিয়ে নতুন করে শুটিং করে ছবি শেষ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে ‘লাডলা’, যা নতুন করে শুটিং করা হয় শ্রীদেবীকে নিয়ে। অসমাপ্ত ছবিগুলোর তালিকায় রয়েছে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি ‘মোহরা’, ‘কর্তব্য’, ‘বিজয়পথ’, ‘দিলওয়ালে’ ও ‘আন্দোলন’। আরও কয়েকটি বড় ব্যানারের ছবির কাজও বন্ধ হয়ে যায় যেগুলোতে অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত ছিল। যেমন অক্ষয় কুমারের সঙ্গে ‘পরিণাম’, সালমন খানের সঙ্গে ‘দো কদম’, ঋষি কাপুরের সঙ্গে ‘কন্যাদান’, সানি দেওলের সঙ্গে ‘বজরঙ্গ’ ও জ্যাকি শ্রফের সঙ্গে ‘চল পে চল’।

১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল মারা গেছেন দিব্যা। ছবি: ফেসবুক
১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল মারা গেছেন দিব্যা। ছবি: ফেসবুক

দিব্যার মৃত্যুর ঠিক আগেই শুটিং শেষ হয়েছিল ‘রং’ ও ‘শতরঞ্জ’ ছবির। মৃত্যুর পরেই মুক্তি পায় দুটি ছবি। বলিউড বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, মাত্র তিন বছরে যে অভিনেত্রী সাফল্যের এই উচ্চতায় উঠতে পারেন, বেঁচে থাকলে হয়তো আজকের দিনে তিনি মাধুরী অথবা শ্রীদেবীর মতোই হয়ে উঠতেন বলিউডের আরেক কিংবদন্তি নায়িকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিব্যার অকালমৃত্যু না হলে শ্রীদেবী, জুহি এবং মাধুরী দীক্ষিতদের হিসেব নিকেশটা অন্যরকম হতো।