রবিশঙ্করের সঙ্গে শেষ দেখা

পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর দিল্লির বাসভবনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর দিল্লির বাসভবনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

স্বাধীনতার ৪০তম বর্ষে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর প্রধান উদ্যোক্তা পণ্ডিত রবিশঙ্করকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল প্রথম আলো। তখন তাঁর দিল্লির বাসভবনে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক। তা নিয়ে মতিউর রহমানের লেখা ১৪ ডিসেম্বর ২০১২ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই লেখার সংক্ষেপিত সংস্করণ।

একাত্তরের ১ আগস্ট ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ মানবতার জন্য পৃথিবীর প্রথম সফল সংগীত আয়োজন। কনসার্টের শুরুতেই রবিশঙ্কর বাজিয়েছিলেন বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরে রচিত ‘বাংলা ধুন’। আর কনসার্টের শেষ গান ছিল জর্জ হ্যারিসনের কান্নার সুরে বাঁধা সেই ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গান।

রবিশঙ্কর ওই অনুষ্ঠানের দুই দিন পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমার যে অনুভূতি, তার পুরোটাই ব্যক্তিপর্যায়ের। এর কারণ, আমি নিজে একজন বাঙালি।’ এই বাঙালি রবিশঙ্করের বাবা শ্যামশঙ্করের জন্ম বাংলাদেশের নড়াইলের নবগঙ্গা নদীতীরের কালিয়া গ্রামে।

সেদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে আলাপচারিতার সময় তাঁকে বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি পিতার জন্মভূমি কালিয়ার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘১৯৪০ সালে দাদার (উদয়শঙ্কর) সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলাম, নদীপথে যাওয়ার সময় কালিয়ায় নেমে মাথায় মাটির ছোঁয়া নিয়েছিলাম।’ বলেছিলেন, ‘ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে বাবার (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ) বাড়ি হয়ে গিয়েছিলাম।’ সেই স্মৃতি রবিশঙ্কর সারা জীবন মনের গভীরে বহন করে চলেছেন।

পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবি: সংগৃহীত
পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের (প্রথম আলো) ইচ্ছা ছিল রবিশঙ্করকে শেষবারের মতো ঢাকায় আনার। সে কথা বলতেই এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন আরেকবার বাংলাদেশে আসবেন, একটি অনুষ্ঠান করবেন। আমাদের এই চেষ্টা চলছিল প্রায় তিন বছর ধরে। কিন্তু সব প্রস্তুতির পরও তাঁর স্বাস্থ্যের কারণে সেটি আর হয়ে ওঠেনি।

তবে সেদিন রবিশঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী সুকন্যাশঙ্করের সঙ্গে বেশ অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা আর বাংলাদেশের পুরোনো বন্ধুদের কথা তিনি জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম ও তাঁর স্বামী কমল দাশগুপ্তের কথা। কমল দাশগুপ্তের নাম তিনি মনে করতে পারছিলেন না। প্রশাসক ও শিল্পী আসাফ্উদ্দৌলাহ্র কথাও বেশ বললেন।

১৯৯৭ সালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া, তাঁকে জড়িয়ে ধরার কথা রবিশঙ্কর স্মরণ করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি আবার ঢাকায় এলে শেখ হাসিনা তাঁকে কই মাছ রান্না করে খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আনন্দিত স্বরেই এ কথাগুলো তিনি আমাদের বলেছিলেন।

কফি খেতে খেতে আমাদের কথোপকথন চলছিল। বাংলাদেশ কনসার্ট নিয়ে প্রথম আলোর ১৪ বছরের বিভিন্ন আয়োজন ও লেখালেখিগুলো তাঁকে দিয়েছিলাম। দিয়েছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় গাওয়া গানের সিডির সংকলন জাগরণের গান, প্রথমা প্রকাশনার বই একাত্তরের চিঠি ও প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি বইটি। তিনি অনেক আদরের সঙ্গে উপহারগুলো নিয়েছিলেন। সেসব নিতে নিতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলছিলেন, ‘সুযোগ পেলেই কিন্তু আমি বাংলায় কথা বলি। বাংলা পত্রিকা পড়ি। আমি তো বাঙালি।’ আমি অটোগ্রাফ চাইলে তিনি নামের বানান জেনে নিয়ে বড় বড় অক্ষরে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্বাক্ষর করলেন আমার অটোগ্রাফ খাতায়।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের অটোগ্রাফ।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের অটোগ্রাফ।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে লেখা ও স্বকণ্ঠে গাওয়া তাঁর দুটি গান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। রবিশঙ্কর বললেন, ‘সে সময়ে বড় মনঃকষ্টে ছিলাম। তখন ওই অবস্থাতেই কম্পোজ করেছিলাম দুটি গান। একটি “জয় বাংলা, জয় বাংলা”, অন্যটি “ও ভগবান, খোদাতালা”।’ দুটিই রেকর্ড করেছিল বিখ্যাত অ্যাপেল কোম্পানি। কিন্তু সে রেকর্ড আর কোথাও পাওয়া যায় না।

এই অন্তরে বাঙালি বিশ্বখ্যাত সুরস্রষ্টা রবিশঙ্কর যেভাবে সেদিন সকালে আমাদের গ্রহণ করেছিলেন, তাতে আমরা গভীরভাবে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। দেখছিলাম তাঁর অন্তর্ভেদী দুই চোখের গভীর দৃষ্টি। তাঁর হাসিভরা মুখমণ্ডল। সুকন্যা আর তার নাতনি দ্রুতি সুপ্রসন্নর আনন্দভরা চাহনি।

রবিশঙ্কর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে প্রিয় সংগীতগুরু। কিন্তু আমাদের মনে তো তিনি একেবারে কাছের একজন মানুষ, বাংলাদেশের বাঙালি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের এক সহযোদ্ধা।