মানুষের সঙ্গে এটা অদৃশ্য শক্তির যুদ্ধ

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি-সংগৃহীত।
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি-সংগৃহীত।

বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে দুটি বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন রবীন্দ্রসংগীতের বরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও তাঁর সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার বাংলা নববর্ষের সেই দুই আয়োজনের কোনোটিই থাকছে না। তারপরও ভিন্ন উপায়ে দেশের মানুষের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন তিনি। সোমবার দুপুরে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে তেমনটাই জানালেন। বললেন করোনা মহামারির এই সময়টায় করণীয় কী, তা নিয়েও।

এবারের বৈশাখ আমাদের জন্য কী বার্তা নিয়ে এল?

এটা ঠিক, আমরা মহাদুর্যোগের সময় পার করছি। তবে বিষয়টি এমন নয়, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এমনটা হয়নি। মানুষকে মাঝেমধ্যে এমন ক্রান্তিকালের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এটাও তেমন একটা ক্রান্তিকাল। পয়লা বৈশাখ যেমন নতুন আশা, নতুন প্রত্যাশার সূচক আনে—এই নববর্ষের দিনে এমনটাই প্রত্যাশা।

রবিঠাকুর এ রকম এক মহামারি পাড়ি দিয়েছেন। তিনি মহামারি নিয়ে কী বলে গেছেন?
রবীন্দ্রনাথের সময় দুর্ভিক্ষ তো ছিলই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিনি দেখেননি। তবে আভাস পেয়েই ভীষণ মর্মাহত ছিলেন। আগের সব কটিই তো ছিল মনুষ্যসৃষ্ট, এই রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ কোথাও লিখেছেন। এ রকম ভয়াবহ কিছু দেখেছেন বলেও মনে হয় না।

সুরের ধারা কী করবে এবার?
সুরের ধারা তেমন কিছুই করছে না। সারা দেশের যে পরিস্থিতি, সম্ভবও নয়। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আমি একটা অনুষ্ঠান করেছি, যেটি পয়লা বৈশাখের দিনে দেখানো হবে। এই অনুষ্ঠানে সুরের ধারার বাইরের শিল্পীরাও আছেন।

অনুষ্ঠানের কথা বলছিলেন। তার মানে, এই সময়টায় আপনাকে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে।
প্রয়োজনে বের হচ্ছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং ছিল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা কাজটা করেছি। ৫০ মিনিটের এই অনুষ্ঠানের নাম ‌‘এসো হে বৈশাখ’। চ্যানেল আইয়েরও অনুষ্ঠান করলাম।

অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে কি একটু ধারণা দেবেন?
আমরা যেভাবে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান করি, ওভাবে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে যেমনটা হওয়া উচিত। ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে করেছি। প্রার্থনা করেছি, আশার কথা বলেছি, বৈশাখের আমেজ রাখার চেষ্টা করেছি। সবার মধ্যে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। এখন তো এমন একটা অবস্থা হয়েছে, দিন-তারিখই ভুলে যেতে বসেছি। বৈশাখের সকালে সবাই যখন টেলিভিশনে দেখবে, তখন উপলব্ধি করতে পারবে, আজ পয়লা বৈশাখ। আমরা ছয়জন শিল্পী পঞ্চকবির আটটি গান গেয়েছি।

চৈত্রসংক্রান্তি, বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান করতেন। পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে বরণের আহ্বান জানাতেন। করোনার কারণে এবার তা হচ্ছে না। সংকটের এই সময়ে সবার উদ্দেশে আপনার কী বলার আছে?
রবীন্দ্রনাথের উক্তিটাই বলব, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’—এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে। আমি বলব, এই আপদ বিদায় হোক। এখন সবার মধ্যে একটা হতাশা। তবে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জন্ম-মৃত্যু—সবকিছু নিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ একটা জীবন। এটাই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং রোমাঞ্চকর দিক। আমরা কেউই জানি না, আগামীকালের প্রভাত কী নিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরও জীবন এগোনোর অনুপ্রেরণা দেয়। যা কিছু অশুভ, অমঙ্গল; তা কখনোই স্থায়ী হয় না। আমাদের সবার জন্য শুভ ও মঙ্গলময় কিছু অবশ্যই আছে। পয়লা বৈশাখের দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক, নতুন বছর মঙ্গল বয়ে আনুক, পৃথিবীতে শান্তি আসুক।

সহস্র কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে গাইছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি-সংগৃহীত।
সহস্র কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে গাইছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি-সংগৃহীত।

ছোট পরিসরে পয়লা বৈশাখের আয়োজনের পেছনে কোন ভাবনাটা কাজ করেছে?
সহস্র কণ্ঠে বর্ষবরণে একধরনের আনন্দ আছে, উৎসব আছে, আয়োজন আছে, সম্মিলন আছে—কিন্তু পুরোটাই বাহ্যিক। আড়ালে কিন্তু আরেকটা বিষয় থাকে—আত্মিক শুদ্ধি। এবার বাহ্যিকভাবে করতে পারছি না, আত্মিকভাবে তো পারছি। প্রত্যেকে নিজের ঘরে বসে প্রার্থনা করতেই পারি। সবাই মিলে একসঙ্গে ভালো-মন্দ খাওয়া, গল্প–গুজব করা, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা। এসবের মধ্য দিয়েও নিজের আত্মিক উন্মেষ ঘটাতে পারি। এই সংকটে সবাই বৈশাখের দিনে বিষণ্ন মন নিয়ে যেন ঘরে বসে না থাকে, জীবন শেষ হয়ে গেল এমনটা যেন কেউ না ভাবে। তাই এই আয়োজন। জীবন চলমান। এ ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে পয়লা বৈশাখ পার করছি, এটাও অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করবে।

সুরের ধারা বড় দুটি আয়োজন করতে না পারায় এ নিয়ে কিছু বলার আছে কি?
এবার হয়নি, সামনে হবে। এই যে পরিস্থিতি, তা আমাদের হাতে নেই। যা আমাদের হাতে নেই, তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। এটাকে অস্বীকার করে পয়লা বৈশাখের বড় আয়োজনে করতে পারি না। সবার স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সমাজের এবং পুরো পৃথিবীর মানুষের স্বার্থে এটা বন্ধ রাখতে হবে। ভাবছিলাম, এর বাইরে আর কী করা যেতে পারে, তখনই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানটি করলাম।

করোনা নিয়ে অনেকের অনেক রকম উপলব্ধি। আপনার কী উপলব্ধি?
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিংবা অন্য সব অসুখের মতো এটাও একটা অসুখ। তবে অনেক বেশি জটিল। চিকিৎসাও যেহেতু নেই, আমরা জানি না এই অসুখের বৈশিষ্ট্য কী। অর্থনীতির ছাত্রী ছিলাম তো, সে হিসেবে রবার্ট ম্যালথাসের থিওরি মনে পড়ে গেল, ‌পৃথিবীতে যখন জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যায়, এক শ দুই শ বছর পর এমন একটা মহামারি আসে, যা দিয়ে জনসংখ্যা কমায়। পৃথিবী তার ভার কমায়। যখন পড়েছিলাম, খুব হাস্যকর মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে, এটাই সত্যি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যারা মনে করে পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে, করোনার কারণে তাদের সব সিস্টেম ভেঙে পড়েছে! সময়ের সঙ্গে মহামারিগুলোও আকার বদলাচ্ছে, মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

করোনার এই সময়টায় সবার সচেতনতা তৈরিতে আপনার কী বলার আছে?
ঘরে থাকো। ঘরে থেকে এই ভাইরাস থেকে নিজেকে দূরে রাখো। এর বিকল্প তো আমরা কিছুই জানি না। আমি বিশেষজ্ঞ নই। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে যেটা বুঝতে পারছি, নিয়ম যাঁরা মানছেন, তাঁদের সমস্যা নেই। আমি এটা বুঝতে পারছি না, অনেকেই করোনার ভয়াবহতা বুঝতেই পারছেন না! যেহেতু বিষয়টার গুরুত্ব তাঁরা বুঝতে পারছেন না, যে ভাষায় বুঝতে পারবে, সে ভাষায় বোঝানো উচিত।

সহস্র কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংকে সম্মাননা তুলে দিচ্ছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও ফরিদুর রেজা সাগর। ছবি-সংগৃহীত
সহস্র কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংকে সম্মাননা তুলে দিচ্ছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও ফরিদুর রেজা সাগর। ছবি-সংগৃহীত

কেউ বলছে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ; কেউবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও বলছেন।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো বটেই। মানুষের সঙ্গে এটা অদৃশ্য শক্তির যুদ্ধ, যা খালি চোখে দেখছি না।

করোনাভাইরাস এই সময়টায় কি কোনো শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন?
মানুষ মানুষের জন্য—এই শিক্ষাটাই ভালো করে দিয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাস হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, সাদা, কালো, ধনী, দরিদ্র—কোনো বাছবিচার নেই। সবাই মরছে। করোনার কারণে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছে। হিংসা, বিদ্বেষ ভুলে গেছে। মানবিক হতে শিখছে মানুষ। এই শিক্ষা আমাদের ধারণ করতে হবে।