শ্রমিকশ্রেণিকে নিয়ে তৈরি যে সিনেমা

এ সিনেমাগুলো শুধু নান্দনিক খিদেই মেটে না, মনের মধ্যে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়। ছবি: সংগৃহীত
এ সিনেমাগুলো শুধু নান্দনিক খিদেই মেটে না, মনের মধ্যে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়। ছবি: সংগৃহীত

যখন সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের মধ্যে সরাসরি বিরোধ ছিল পৃথিবীজুড়ে, তখন মে দিবস পালিত হতো অন্যভাবে। দৃঢ়প্রত্যয়ী শ্রমিক শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমের অঙ্গীকারে এক হতেন। রাজপথ ছেয়ে যেত লাল পতাকার মিছিলে। কৃষকেরাও যোগ দিতেন সেই মহামিলনে।

সেই যুগ চলে গেছে। এখন তা ম্রিয়মাণ। কিন্তু কান পাতলে মালিকে–শ্রমিকে সম্পর্কের মধ্যে এখনো শোষণ–বঞ্চনার আর্তনাদ শোনা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটিয়েছে ঠিকই, কিন্তু শোষিত মানুষকে মেরে ফেলেনি। বরং পৃথিবীজুড়েই মানুষ এখনো সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখে চলেছে।

মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের জয়গান গাওয়ার একটি পরীক্ষিত দিন। অধিকার আদায়ের অঙ্গীকার করার দিন। সংস্কৃতি অঙ্গনেও এই দিনের রয়েছে প্রবল ছায়াপাত। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় শ্রমিকশ্রেণিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। সেই ছায়াছবিগুলো নিজ বৈশিষ্ট্যেই বাহ্বা পেয়েছে মানুষের।

এখানে এমন তিনটি ছায়াছবি নিয়ে কথা বলব, যেগুলো দেখলে শুধু নান্দনিক খিদেই মেটে না, মনের মধ্যে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়। মানুষে মানুষে পরিচয়ের হিসেব–নিকেশ নিয়ে তৈরি ভাবনাকেও উসকে দেয় তা।

জন সেইলেসের পরিচালনায় মেইটওয়ান ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
জন সেইলেসের পরিচালনায় মেইটওয়ান ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

মেইটওয়ান

মেইটওয়ান একটি ছোট শহর। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে তার অবস্থান। ১৯২০ সালের এক কয়লাখনি নিয়ে ছবির কাহিনি। কয়লাখনির শ্রমিকেরা ইউনিয়নে যূথবদ্ধ হয়ে ডাক দেয় ধর্মঘটের। তাদের দাবি ছিল কাজের পরিবেশ উন্নত করা আর মজুরি বাড়ানো। কয়লাখনির মালিক এই অঞ্চলের একমাত্র মানুষ, যে মানুষকে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সে তো কোনোভাবেই নতি স্বীকার করবে না। তখন সে ধর্মঘট ভাঙার জন্য নিয়োগ করল ইতালীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ কিছুসংখ্যক শ্রমিককে। ধর্মঘটিদের মধ্য থেকেই যারা ধর্মঘটিদের মধ্যে ভাঙন ধরাবে এবং নিজেরা ধর্মঘট ভেঙে যোগ দেবে কাজে। বড় শহর থেকে আসা তুখোড় ট্রেড ইউনিয়নিস্ট জো কেনেহ্যান এই ইতালীয় আর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বোঝাতে সক্ষম হয় যে এ লড়াই সবার বাঁচার লড়াই। এরপর কাহিনি এগোতে থাকে চমকপ্রদভাবে।
জন সেইলেসের পরিচালনায় মেইটওয়ান ছবিটিতে অভিনয় করেছেন ক্রিস কুপার, জেমস আর্ল জোনস, ম্যারি ম্যাকডোনাল।

ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। সেরা চিত্রনাট্যের জন্য অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিল ছবিটি।

নরমা রে ছবিতে নরমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যালি ফিল্ড। ছবি: সংগৃহীত
নরমা রে ছবিতে নরমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যালি ফিল্ড। ছবি: সংগৃহীত

নরমা রে
পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই নরমা রে কাজ করে এই অঞ্চলের পোশাক কারখানায়। এখানে কাজ করাই যেন তাদের ভাগ্যলিখন। সারা দিন ঘাম ঝরানোর পর যে মজুরি পায়, তা নিতান্তই কম। আর কাজের পরিবেশও জঘন্য। একদিন শ্রমিকনেতা রুবেনের বক্তৃতায় মোহিত হয়ে পড়ে নরমা রে। সে যোগ দেয় শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনে। এতে নাখোশ হয় তার পরিবার। বেশি অখুশি হয় তার প্রেমিক। পদে পদে আসতে থাকে বাধা। কিন্তু নিজের দাবিতে রে থাকে অটল। পোশাককর্মী থেকে ইউনিয়নের নেতা হয়ে যাওয়া ক্রিস্টাল লি সুটনের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনেই ছবিটি তৈরি হয়েছে। পরিচালক মার্টিন রিট। ছবিতে নরমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যালি ফিল্ড। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কারজয়ী হন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে।

অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট ছবিটা অস্কারে ১২টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় ।ছবি: সংগৃহীত
অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট ছবিটা অস্কারে ১২টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় ।ছবি: সংগৃহীত

অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট
এই ছবি বারবার দেখা যায়। ইলিয়া কাজান পরিচালিত ছবিটির মূল আকর্ষণ মার্লোন ব্রান্ডোর অসাধারণ অভিনয়। আরও অভিনয় করেছেন কার্ল ম্যালডেন, লি জে কব।

টেরি ম্যালয় একজন যোদ্ধা হতে চায়। জিতে নিতে চায় পুরস্কার। জনি ফ্রেন্ডলি নামে এক ট্রেড ইউনিয়নিস্টের জন্য কাজ করে সে। মোটামুটি ভালোই চলছিল দিন। কিন্তু একদিন হঠাৎ টেরির মাথায় বাজ পড়ে। সে নিজ চোখে দেখে ফেলে, জনির দুই ষণ্ডা মাস্তান খুন করছে একজনকে। যাকে খুন করা হলো, তার বোনের সঙ্গে দেখা হয় টেরির। বুঝতে পারে, এ হত্যার দায় শোধ করতে হবে। কীভাবে আদালতে বিষয়টি নিয়ে লড়তে হবে, সেই পরামর্শ দেয় ফাদার ব্যারি। কীভাবে ইউনিয়ন বাজি করা মাস্তানদের রুখে দিতে হয়, সেটাও উঠে আসে ছবিতে।

ছবিটা অস্কারে ১২টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারসহ আটটি পুরস্কার জোটে ছবিটির ভাগ্যে। সমালোচকদের পাশাপাশি দর্শকেরাও ছবিটিকে দারুণভাবে গ্রহণ করেন।
ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে।