ঋষি কাপুরের এক জীবন

ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম


দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বোনম্যারো ক্যানসারে ভুগছিলেন ঋষি কাপুর। ইরফান খান চলে গেলেন ২৪ ঘণ্টাও হয়নি। আর গতকাল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে মুম্বাইয়ের স্যার এইচ এন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালে শেষবারের মতো শ্বাস নেন ঋষি কাপুর। আগের রাতেই ৭৩ বছর বয়সী বড় ভাই রণধীর কাপুর জানিয়েছিলেন, ঋষি ভালো নেই। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তবে তিনি লাইফ সাপোর্টে যেতে চাইছিলেন না।


জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক ঋষি কাপুর। জীবনসঙ্গী নিতু কাপুরও বড় পর্দার তারকা। মেয়ে ঋদ্ধিমা কাপুর ফ্যাশন ডিজাইনার। ছেলে রণবীর কাপুর বলিউডের কাপুর খানদানের পারিবারিক পেশা অনুসরণ করে হয়েছেন আরেকজন বলিউড তারকা।

১৯৫২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত বলিউড অভিনেতা ও পরিচালক রাজ কাপুর ও কৃষ্ণা রাজ কাপুরের ঘরে জন্ম নেন ঋষি কাপুর। ১৯৭০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে ৯০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। প্রথমবার বড় পর্দায় ছোট্ট ঋষির দেখা মেলে বলিউডের আইকনিক ছবি ‘শ্রী৪২০’–এ। ১৯৫৫ সালে। বয়স তিন বছরও হয়নি। রাজ কাপুর আর নার্গিস ছাতা মাথায় ‘প্যায়ার হুয়া, ইকরার হুয়া’ গানটি গাইতে গাইতে পিচের রাস্তা ধরে চলেছেন আর পাশ দিয়ে চলে হাতে হাত রেখে চলে গেল রেইনকোট পরা তিনটি শিশু। এই তিনজনের হলেন ঋষি কপুর। বাবার সঙ্গে শুটিং দেখতে এসেছিল ছোট্ট ঋষি। আর নার্গিস তাঁকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ওই দৃশ্য করিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় বাবা রাজ কাপুরের পরিচালনা ও প্রযোজনায় ঋষি কাপুর অভিনীত প্রথম ছবি ‘মেরে নাম জোকার’। প্রথম ছবিতেই শিশু শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলেন ঋষি।

স্ত্রীর সঙ্গে ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
স্ত্রীর সঙ্গে ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

১৯৭৩ সালে মুক্তি পেল কিশোর প্রেমের ওপর নির্মিত প্রধান চরিত্রে ঋষি কাপুর অভিনীত প্রথম ছবি—‘ববি’। সঙ্গী ছিলেন ডিম্পল কাপাডিয়া। এই ছবিরও পরিচালক ছিলেন ঋষি কাপুরের বাবা রাজ কাপুর। তিনি নাকি এই ছবির জন্য রাজেশ খান্নাকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজেশ খান্নার পারিশ্রমিক দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বলে ছেলেকে দিয়েই ছবিটি করিয়েছিলেন। বড় পর্দার সেই ববি আর রাজা—দুজনকেই ভালোবেসেছিল ভারত। ‘ববি’ তুমুল হিট হয়। আর ঋষি কাপুরকে এনে দেয় সেরা অভিনেতার ফিল্মফেয়ার।

১৯৭৩ সালে ‘ববি’ ছবির প্রিমিয়ার শোতে ঋষি কাপুরের দেখা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। রাজ কাপুর তাঁর মেজ ছেলে ঋষিকে সত্যজিতের সামনে এনে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘প্রণাম করো, ইনি সব পরিচালকের বড় পরিচালক।’ সত্যজিৎ রায় সেদিন হাসিমুখে আশীর্বাদ করেছিলেন ২০ পেরোনো তরুণ ঋষিকে। পরবর্তী সময়ে সত্যজিতে মুগ্ধ হন ঋষি কাপুর। সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিটি তিনি তিনবার দেখেছিলেন। ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন ঋষি কাপুর, তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল দার্জিলিং। হেমন্ত আর মান্না দে ছিলেন তাঁর প্রিয় গায়ক। সুপ্রিয়া চৌধুরীকে তাঁর নায়িকা হিসেবে দারুণ পছন্দ ছিল। উত্তমকুমারের ৩ নম্বর ময়রা স্ট্রিটের ঠিকানায় তিনি একাধিকবার গিয়েছেন।

আধুনিক ভারতের প্রেমের দূত ছিলেন ঋষি। ১৯৭০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই ২০ বছর ক্যারিয়ারের দিক থেকে ঋষি কাপুরের জীবনের সেরা সময়। ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ‘কুলি‌’, ‘রাজা’, ‘লাইলা মজনু’, ‘সারগাম’, ‘প্রেম রোগ’, ‘হানিমুন, ‘চান্দনি’, ‘হেনা’, ‘বোল রাধা বোল’, ‘দো দোনি চার’, ‘হাম কিসিসে কাম নেহি’, ‘কাভি কাভি’, ‘লাভ আজকাল’, ‘রাজমা চাউল’, ‘অগ্নিপথ’, ‘হাম তুম’, ‘ফানা’, ‘মুলক’, ‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’ ঋষির উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর ভেতর অন্যতম। নামের আগে সুপারস্টার যুক্ত হয়েছিল সত্যি, আবার ব্যর্থতার ছায়া যে একটু হলেও জীবনকে ঢেকে দিয়েছিল, সেটিও অস্বীকার করা যাবে না। ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সাল, এই ২৮ বছরে ৫১টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল, যেখানে ঋষি কাপুর ছিলেন একমাত্র নায়ক। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১১টি ছবি বক্স অফিসে সফল হয়েছিল। ঋষি কাপুর শেষবারের বড় পর্দায় দেখা দেন ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর। ‘দ্য বডি’ ছবিতে। এরপর তাঁকে দেখা যাবে ‘দ্য ইন্টার্ন’-এর হিন্দি রিমেকে দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে। নিউইয়র্ক থেকে ফিরেও ‘শর্মাজি নমকিন’ নামে একটি ছবিতে জুহি চাওলার সঙ্গে শুটিং শুরু করেছিলেন ঋষি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তা বাতিল হয়ে যায়।

ছেলের হাত থেকে ফিল্মফেয়ারে আজীবন সম্মাননা নিচ্ছেন ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
ছেলের হাত থেকে ফিল্মফেয়ারে আজীবন সম্মাননা নিচ্ছেন ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

অভিনয়জীবন তাঁকে ‘চকলেট বয়’, ‘সুপারস্টার’ ইমেজ ছাড়াও খুঁজে দিয়েছে জীবনসঙ্গিনী। ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি ঋষি কাপুর বিয়ে করেন তাঁর অনস্ক্রিন আর অফস্ক্রিন প্রেমিকা নিতু সিংকে। মোট ১৫টি ছবিতে নিতু ছিলেন তাঁর নায়িকা। বিয়ের পরে কাপুর পরিবারের ঐতিহ্য মেনে স্বেচ্ছায় অভিনয় ছেড়ে বাড়ির বউ হন নিতু। অভিনয় ছেড়ে দেওয়া নিয়ে নিতুর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না। তিনি আর ঋষি দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্বও ছিল। বিয়ের আগে ভেঙে যাওয়া প্রেম, বিয়ের পরের বান্ধবী, সেটের ঘটনা—স্ত্রীর সঙ্গে সবই শেয়ার করতেন ঋষি। সব ঠিকই ছিল। কেবল ঋষির অতিরিক্ত মদ্যপান সংসারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে দুই সন্তান রণবীর আর ঋদ্ধিমাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন নিতু। পরে আবার ফিরে আসেন। ঋষিও স্ত্রীকে কথা দেন, মদ্যপান কমিয়ে দেবেন। সেই কথা রেখেছিলেন ঋষি। তারপর আর তাঁদের দাম্পত্যের ফাটল প্রকাশ্যে আসেনি।

৬৭–তেই ফুরিয়ে গেলেন ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
৬৭–তেই ফুরিয়ে গেলেন ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

১৯৭৪ সালে প্রথম ‘জেহরিলা ইনসান’ ছবিতে একসঙ্গে পর্দা ভাগ করেন ঋষি কাপুর ও নিতু সিং। তাঁদের সর্বশেষ জুটি বেঁধে অভিনয় করতে দেখা গেছে ‘ধনদৌলত’ ছবিতে, ১৯৮০ সালে। ওই বছরই তাঁরা বিয়ে করেন। বাস্তবের জুটি হওয়ার পর আর মুখ্য চরিত্রে জুটি বেঁধে তাঁদের অভিনয় করা হয়নি। ৩৯ বছর পর আবার একসঙ্গে বড় পর্দায় ফেরার কথা ছিল এই তারকা দম্পতির। কথা ছিল, বলিউডের বড় পর্দায় জুটি বেঁধে দেখা যাবে নন্দিতা দাস ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত, কলকাতার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘বেলাশেষে’র হিন্দি রিমেকে। তা আর হলো না। আগেই জীবনের মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন ঋষি।

বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঋষি কাপুর। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

১১ মাস ১১ দিনের চিকিৎসা শেষে ফিরে ইনস্টাগ্রামে আবেগাপ্লুত ঋষি কাপুর লিখেছিলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আবার জীবনযুদ্ধে ফিরতে পেরেছি। তিনি আমাকে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছেন। আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। আমি এখন ক্যানসারমুক্ত।’ কিন্তু সেই ফেরা ছিল সাময়িক। ছেলেকে প্রায়ই উপদেশ দিয়ে ঋষি কাপুর বলেন, সফলতা যেন তাঁর মাথায় চড়ে না বসে, ব্যর্থতা যেন তাঁকে ভেঙে চুরমার করে না ফেলে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও তিনি বলেছিলেন, তাঁর হৃদয় এখনো তরুণ। শিগগিরই তিনি বড় পর্দায় আবারও প্রেম করবেন। তা আর হলো কোথায়! একটা তরুণ হৃদয় নিয়েই দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেলেন এই অভিনেতা।