তাঁরা ছিলেন সাদাকালো দিনের নায়ক

এখন তাঁদের প্রধান পরিচয়, চরিত্রাভিনেতা। অতীত পরিচয় ছিল অন্য রকম। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সাদাকালো দিনের চিত্রনায়ক। নায়িকাদের সঙ্গে তাঁরাও জুটি বেঁধেছিলেন। তাঁদের টানে দর্শক দলে দলে সিনেমা হলে ভিড় করতেন। সোনাঝরা সেসব দিনের কথা ভুলতে বসেছেন সবাই। সে রকম কয়েকজন নায়কের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া যাক আজ।

সৈয়দ হাসান ইমাম। ছবি: সংগৃহীত
সৈয়দ হাসান ইমাম। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ হাসান ইমাম
সৈয়দ হাসান ইমাম এই প্রজন্মের কাছে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বেশি পরিচিত। এর বাইরে চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও তাঁকে চেনেন দর্শকেরা। কিছুদিন আগে ঝরা পাতার দিন নাটকে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে। অথচ হাসান ইমাম একসময় চরিত্রাভিনেতা ছিলেন না, ছিলেন পুরোদস্তুর নায়ক। সোনালি যুগের সফল নায়ক হাসান ইমামকে অনেকেই ভুলতে বসেছেন।
নায়ক হাসান ইমামের ছবির তালিকা ছোট নয়। পরোয়ানা ও ধারাপাত ছবি দুটোতেই তাঁর দুজন নায়িকা ছিলেন। নাসিমা খান ও সুজাতা। অনেক দিনের চেনা ছবিতে সুলতানা জামান, রাজা এলো শহরে ছবিতে চিত্রা সিনহা, জানাজানি ছবিতে সুলতানা জামান, উজালা—ছবিতে নাসিমা খান, আবার বনবাসে রূপবান-এ সুলতানা জামান। অপরাজেয় ছবিতে সুজাতা। উলঝন-এ নাসিমা খান ও রোজি। ময়ূর পঙ্খী ছবিতে সুলতানা জামান। জীনা ভি মুশকিল-এ রেশমা। কসম উস ওয়াক্তি ছবিতে রোজিনা। সোয়ে নদীয়া জাগে পানি ছবিতে কবরী ও রোজী। ভাগ্যচক্র ছবিতে নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী ও শাবানা। গাজী কালু চম্পাবতী ছবিতে সুজাতা।
নায়ক হিসেবে হাসান ইমাম অভিনীত সবশেষ ছবি নিমাই সন্ন্যাসী। এতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সামিনা। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালে। তারপর থেকে আর নায়কের চরিত্রে তাঁকে দেখা যায়নি।

আনোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
আনোয়ার হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

আনোয়ার হোসেন
আনোয়ার হোসেন প্রথম নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে পারিশ্রমিক পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। সেটি ছিল সালাহউদ্দিন পরিচালিত সূর্যস্নান। আনোয়ার হোসেনকে এ দেশের দর্শক মাথায় তুলে রেখেছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা হিসেবে। এই একটি ছবির নায়ক হিসেবে একটি প্রজন্ম হয়তো তাঁকে মনে রাখবে। তবে তিনি নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন বহু ছবিতে। তাঁকে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে বছরের পর বছর একটানা কাজ করতে দেখেছেন বাংলা ছবির দর্শকেরা। অথচ তিনিও একসময় ব্যস্ত নায়ক ছিলেন।
পাঠকেরা জেনে অবাক হবেন, আনোয়ার হোসেন সোনালি যুগে ছিলেন ঐতিহাসিক চরিত্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নায়ক। শুধু সিরাজ নয়, রাজা সন্ন্যাসী ছবিতে রমেন্দ্র নারায়ণ রায়, শহীদ তীতুমীর ছবিতে তীতুমীর, গাজী কালু চম্পাবতী ছবিতে গাজী, ঈশা খাঁ ছবিতে ঈশা চরিত্র যেন তাঁর জন্যই লেখা হয়েছিল।
বহু ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। এ রকমই এক ছবি লাঠিয়াল-এ অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। কাঁচের দেয়াল, অভিশাপ, দুই দিগন্ত ছবিতে তাঁর চরিত্রটিকে নায়ক বলা যায় অনায়াসে। এই তিন ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন সুমিতা।
আনোয়ার হোসেন চরিত্রাভিনেতা হিসেবে দর্শকমনে গেঁথে গেলেও ষাটের দশকে নায়ক হিসেবে তাঁর রয়েছে বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতা। চলচ্চিত্রের প্রথম যুগের নায়কদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সেই দিক থেকে তাঁর অভিনয়জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক অংশে তিনি ছিলেন নায়ক কাম চরিত্রাভিনেতা। আরেক অংশে প্রচণ্ড ব্যস্ত চরিত্রাভিনেতা।

খলিলউল্লাহ খান। ছবি: সংগৃহীত
খলিলউল্লাহ খান। ছবি: সংগৃহীত

খলিলউল্লাহ খান
খলিলকে এই প্রজন্ম চেনে জাঁদরেল চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। ২০১৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নানা রকম চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তারও আগে তিনি ছিলেন খলনায়ক। তাঁর দাপুটে অভিনয়ে রুপালি পর্দা কেঁপেছে। মন্দ চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই চরিত্রাভিনেতার জায়গাটি তাঁর পোক্ত হয়ে যায়।
নানা রঙের চরিত্রে তাঁর অভিনয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন। তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল নায়ক হিসেবে। ষাটের দশকে খলিল ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক। নায়ক হিসেবে তাঁর অভিনীত ছবিগুলো হলো সোনার কাজল, প্রীত না জানে রীত, সংগম, কাজল, ক্যায়সে কুঁহু, বেগানা, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, গোর এবং জংলী ফুল।
সোনার কাজল খলিলের প্রথম ছবি। পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান ও কলিম শরাফী। সোনার কাজল ছবির কাহিনিতে খলিল প্রথমে ছিলেন গ্রামের ছেলে। শহরে এসে তাঁর পরিচয় হয় সুলতানা জামানের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর মিলন হয় গ্রামের মেয়ে সুমিতা দেবীর সঙ্গে। নায়িকা হিসেবে খলিল পেয়েছেন প্রীত না জানে রীত-এ শবনম, সংগম-এ সুমিতা দেবী, কাজল-এ শবনম, ক্যায়সে কুঁহুতে শবনম, ভাওয়াল সন্ন্যাসীতে রেশমা এবং জংলী ফুল-এ সুলতানা জামানকে।
১৯৭৬ সালে গুন্ডা ছবির জন্য ‘শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-অভিনেতা’ হিসেবে তিনি পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জীবদ্দশায় আজীবন চলচ্চিত্র সম্মাননা ও একুশে পদকও পেয়েছিলেন।

খান আতাউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
খান আতাউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

খান আতাউর রহমান
লন্ডন থেকে ফিরেছেন খান আতা। কী করবেন পুরোপুরি ভেবে ওঠেননি। একদিন লন্ডনফেরত শুভার্থীদের আড্ডায় এ জে কারদার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমার ছবির নায়ক হবে?’ খান আতা বললেন, ‘চাঁছাছোলা চেহারার লোককে আপনি নায়ক বানাবেন?’ উত্তরে কারদার বললেন, ‘জেলে সম্প্রদায়ের লোক কি কন্দর্পকান্তি হবে নাকি?’
এভাবেই এ দেশের প্রাথমিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ ছবি এ জে কারদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাভেরায় নায়ক হিসেবে যুক্ত হন খান আতা। এই প্রজন্মের দর্শক তাঁকে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে বহু ছবিতে অভিনয় করতে দেখেছেন। তাঁর পরিচালনায় কালজয়ী ছবিগুলোর সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় আছে। তাঁর সুরারোপিত জনপ্রিয় গানগুলোও বহু মানুষের শোনা। তিনি মোট চারটি ছবিতে নায়ক হয়েছেন। পরে তিনি হয়ে যান পরিচালক। অভিনয় চালিয়ে গেলেও আর কখনো নায়ক হননি। এভাবেই ‘আনিস’ নামটি তাঁর হারিয়ে যায় চিরতরে। এ নামেই তিনি নায়ক হিসেবে অভিনয় করতেন।
জাগো হুয়া সাভেরা ছাড়া আর যে তিনটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন, সেগুলো হচ্ছে এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার, সালাহউদ্দিন পরিচালিত যে নদী মরুপথে এবং জহির রায়হান পরিচালিত কখনো আসেনি। জাগো হুয়া সাভেরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। কলকাতার বিখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র ছিলেন ছবির নায়িকা। এ দেশ তোমার আমার-এ নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী। ছবির জন্য গানও লেখেন খান আতা। কখনো আসেনিতে তিনি সংগীত পরিচালনা করেন। নায়িকা ছিলেন সুমিতা দেবী ও শবনম।
যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁরা ছাড়াও চরিত্রাভিনেতা, সোনালি যুগের নায়ক হিসেবে সফল ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, সুভাষ দত্ত, শওকত আকবর, আমিনুল হক, কায়েস প্রমুখ।