ভাগাভাগিতেই জীবনের আসল সুখ

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড, ‌দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য উইন্ড-প্যাডম্যান সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে বানানো তিনটি সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত
ইনটু দ্য ওয়াইল্ড, ‌দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য উইন্ড-প্যাডম্যান সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে বানানো তিনটি সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও।' এ কথাটা মনে হয় পৌঁছে গিয়েছিল মার্কিন তরুণ খ্রিস্টোফারের কানে। ধনী পরিবারের মেধাবী ছেলেটা পড়াশোনা শেষ করে একদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, সুখের সন্ধানে। কাউকে কিচ্ছুটি বলেন না, সঙ্গে একটা ডলারও নেন না, বরং যা জমা করেছিলেন, তা দাতব্য সংস্থাকে দিয়ে যান।

বাড়ি থেকে বহুদূরের পরিত্যক্ত এক বাসে ঠাঁই নেন খ্রিস্টোফার। যাত্রাপথের বিভিন্ন মানুষ আর অভিজ্ঞতা তাঁকে শেখায়, জীবনে সুখের জন্য টাকা নয়, ভালোবাসাটাই মূল। ধনী পরিবারে বেড়ে উঠলেও ভালোবাসার বড় আকাল ছিল সেখানে। ছিল শুধু অশ্রদ্ধা, অসম্মান আর সংঘাত। সুখের সন্ধান পেয়ে যারপরনাই খুশি তিনি। মনস্থির করেন বাড়ি ফিরে যাওয়ার। সবার সঙ্গে ভালোবাসা ভাগাভাগি করে নেওয়ার।

বাড়ি থেকে বহুদূরের পরিত্যক্ত এক বাসে ঠাঁই নেন খ্রিস্টোফার। ছবি: সংগৃহীত
বাড়ি থেকে বহুদূরের পরিত্যক্ত এক বাসে ঠাঁই নেন খ্রিস্টোফার। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না। আসার সময় যে নদী বরফে শক্ত হয়ে ছিল, তা খরস্রোতা পানিতে ভরে যায়। আটকা পড়ে যান খ্রিস্টোফার। খেয়ে ফেলেন এক বিষাক্ত ফল। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি লিখে যান, ‘সবকিছু ভাগাভাগি করে নেওয়াতেই জীবনের আসল সুখ।’
খ্রিস্টোফারের একেবারে বিপরীত আর্থসামাজিক অবস্থায় বাস কিশোর উইলিয়ামের। আফ্রিকার দরিদ্র দেশ মালাবির প্রত্যন্ত এক গ্রামে থাকে সে। তার পরিবারে টাকা নেই, তবে ভালোবাসা আছে। দারিদ্র্যের কঠিন দিনগুলো একসঙ্গে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা আছে। বন্যা আর খরায় ফসল হয় না। খেয়েপরে বেঁচে থাকাটা যখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন বেতন দিতে না পেরে পড়াশোনাটাই বন্ধ হয়ে যায় উইলিয়ামের। কিন্তু এই কিশোর চায়, পরিবারকে কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিতে। অভাবে পড়া মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে পটিয়ে লাইব্রেরিতে বসে বই ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে ফেলে উইন্ডমিল বানানোর কৌশল।

দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য উইন্ড-এর দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য উইন্ড-এর দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

উইন্ডমিলের ছোট্ট একটা নমুনা বানায় উইলিয়াম। বাবাকে দেখিয়ে বলে, ‘তোমার জন্য আমি পানি এনে দিতে পারব! অভাব-দারিদ্র্যে দিশেহারা বাবা ছেলের কথা কানে তোলেন না। এরপর ছেলে যখন সত্যিকারের উইন্ডমিল বানানোর জন্য বাবার সাইকেলটা চেয়ে বসে, বাবা রেগে আগুন হয়ে যান। মা পাশে দাঁড়ান। স্থানীয় সব উপকরণ দিয়ে উইলিয়াম সত্যিকারের উইন্ডমিল বানিয়ে ফেলে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পায় পানি। যে পানিতে ধূসর মাটি হয়ে যায় চাষযোগ্য। সবুজে ভরে ওঠে চারপাশের ফসলের জমি। কিশোরের এই প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে মালাবির গ্রাম থেকে গ্রামে। এমনকি আশপাশের দেশেও।

ভারতের দরিদ্র ও রক্ষণশীল সমাজে বড় হওয়া যুবক লক্ষ্মী চৌহানের কাছে সুখ একটু অন্য রকম। স্ত্রীকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। স্ত্রীকে নিয়ে সুখে থাকতে চান। কিন্তু মাসের কয়টা দিন মাসিক নিয়ে স্ত্রীকে অনেক কষ্ট সইতে হয়। এই সময়টায় সুখ না হোক, একটু স্বস্তি দিতে কাঠখড় পুড়িয়ে প্যাড বানান তিনি। অল্প দামের, যেন সব নারীই ব্যবহার করতে পারেন। কুসংস্কার আর অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতি পেছনে ফেলে তাঁরা সুরক্ষিত থাকতে পারেন।

প্যাডম্যান- সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে বানানো সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত
প্যাডম্যান- সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে বানানো সিনেমা। ছবি: সংগৃহীত

পুরুষ হয়ে নারীর সুখ-স্বস্তি, তা–ও আবার মাসিক বা প্যাডের মতো অনুচ্চারিত বিষয় নিয়ে কাজ করায় লক্ষ্মী চৌহানকে লোকের কটু কথা শুনতে হয়। হাসিঠাট্টা চলে হরহামেশা। কিন্তু কিছুই দমাতে পারে না তাঁকে। মানুষের উপকারে আসা আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি মেলে তাঁর। পেয়ে যান রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও।

লক্ষ্মী চাইলেই তাঁর মেশিন ও কৌশলটা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বেচে দিতে পারতেন। বিনিময়ে অনেক টাকা পেতেন। আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। তিনি চান, গ্রামে গ্রামে দরিদ্র নারীরা এই প্রযুক্তি দিয়ে নিজেরাই প্যাড বানিয়ে বিক্রি করুক। এতে নারীরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বীও হলো, আবার স্বাস্থ্যের দিক থেকেও সুরক্ষিত থাকল। এই ভাগাভাগিতেই তাঁর সুখ।

ইনটু দ্য ওয়াইল্ড-এর খ্রিস্টোফার, ‌দ্য বয় হু হার্নেসড দ্য উইন্ড-এর উইলিয়াম আর প্যাডম্যান-এর লক্ষ্মী সত্যিকারের ঘটনা নিয়ে বানানো তিনটি সিনেমার চরিত্র। তারা অনায়াসে মানুষের চিরাচরিত সুখের সংজ্ঞাটা বদলে দিতে পারে। এমন দুর্যোগের দিনে তো সেই সম্ভাবনা আরও প্রবল।