করোনাকালেও যুদ্ধংদেহী নেটফ্লিক্স

নেটফ্লিক্সের লোগো। নেটফ্লিক্সে রীতিমতো ঝড় তুলেছে ‘এক্সট্র্যাকশন’ ছবিটি। ছবি: সংগৃহীত
নেটফ্লিক্সের লোগো। নেটফ্লিক্সে রীতিমতো ঝড় তুলেছে ‘এক্সট্র্যাকশন’ ছবিটি। ছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল আরও মাস চারেক আগে। তখন করোনাভাইরাস শুধু চীনে ছিল। মহাপ্রাচীর পেরিয়ে সারা বিশ্বে তখনো ছড়িয়ে পড়েনি। আর এখন পুরো বিশ্ব কাঁপছে করোনা-আতঙ্কে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্ট্রিমিং ওয়ারের তীব্রতা।

তবে হ্যাঁ, এই তীব্রতায় ভিন্নতা আছে। স্ট্রিমিং ওয়ার শুরুর সময়টায় ভিডিও স্ট্রিমিং জগতের জায়ান্ট নেটফ্লিক্স একটু গ্যাঁড়াকলে ছিল। চোখ রাঙাচ্ছিল ডিজনি প্লাস। সাধে কি আর নেটফ্লিক্স প্রধান রিড হেস্টিংস স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে ডিজনিই তাঁর ব্যবসায় ভাগ বসাচ্ছে! তখন সবাই স্ট্রিমিং ওয়ারকে দেখছিল, নেটফ্লিক্সের তখত কেড়ে নেওয়ার লড়াই হিসেবে। আর এখন করোনা মহামারি সব হিসাব পাল্টে দিয়ে বাণিজ্যলক্ষ্মীর জাহাজের পাল আবার নেটফ্লিক্সের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহামারির এই দিনে জীবাণুনাশক মানুষের কাছে যতটা প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখা দিয়েছে, নেটফ্লিক্সের প্রতি মনোযোগও বেড়েছে ঠিক ততখানি! কারণ, ঘরবন্দী মানুষের সময় কাটানোর অন্যতম উপায় বিনোদন। আর ঘরে বসে বিনোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আছে নেটফ্লিক্স। তা কনটেন্টের মান ও সংখ্যা—দুই দিক থেকেই। এসব কারণেই করোনার এই সময়ে ডিজনির চেয়ে বাজারমূল্যে এগিয়ে গেছে নেটফ্লিক্স। অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ১৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

নেটফ্লিক্স আদতে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের স্ট্রিমিং জায়ান্ট হয়েছে। কদিনের গল্প তো নয়! সেই ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু। সিডি-ডিভিডির ঠিকাদারি পার হয়ে প্রথমে ভিডিওস্ট্রিমিং ও পরে অরিজিনাল কনটেন্টে হাত দিয়েছে নেটফ্লিক্স। নিন্দুকেরাও বলে থাকেন, সব পরিস্থিতিতেই নাকি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেটফ্লিক্সের বসদের। এবারও তা প্রমাণ হয়েছে। নতুন প্রতিযোগী, করোনাভাইরাস সব প্রতিবন্ধকতা উতরে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন। মোট গ্রাহক এখন ১৮৩ মিলিয়ন। আর নতুন গ্রাহকদের বেশির ভাগই এসেছে ইউরোপ ও এশিয়ার বাজার থেকে। অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন যে মহামারির কারণে নেটফ্লিক্সের স্ট্রিমিং ব্যবসায় ধস নামতে পারে। কারণ, নতুন সিরিজ বা ছবি বানানোর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে আগে থেকেই ভবিষ্যতের অনেক কাজ এগিয়ে রাখার সংস্কৃতিই এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছে নেটফ্লিক্সকে। আয় বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেনাও কমছে প্রতিষ্ঠানটির।

অবশ্য মাঠ পুরোপুরি খালি পাচ্ছে না নেটফ্লিক্স। বাজারে আসার পাঁচ মাসের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার পেয়ে গেছে ডিজনি প্লাস। ভারতে যাত্রা শুরুর পর থেকেই নেটফ্লিক্সের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ডিজনি। যদিও নেটফ্লিক্সের বাজার অংশীদারি তুলনামূলক বেশি, কিন্তু ডিজনি খুব বড় ব্যবধানে পিছিয়ে নেই। সমস্যা হলো, নেটফ্লিক্সের মতো বিশ্বজুড়ে সব বাজারে এখনো ঢুকতে পারেনি ডিজনি প্লাস।

এর বাইরে আবার মে মাসের ২৭ তারিখ চালু হতে চায় ওয়ার্নার মিডিয়ার নতুন স্ট্রিমিং সার্ভিস এইচবিও ম্যাক্স। কমকাস্ট কোম্পানির পিকক আসতে চাইছে জুলাইয়ে। চাইবে না কেন বলুন? করোনার সময়ে একমাত্র এই ব্যবসাতেই তো প্রবৃদ্ধি আসছে। একটা হিসাব জানাই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসন বলছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে শুধু আমেরিকার বাজারে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ে সময় কাটানোর হার গত বছরের তুলনায় ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। এবার একবার পুরো বিশ্বের কথা ভাবুন। আর কে না জানে, যত গ্রাহক, যত সময় কাটানো, আয় ততই ঊর্ধ্বমুখী!

নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় একটি সিরিজ ‘সেক্রেড গেমস’। ছবি: সংগৃহীত
নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় একটি সিরিজ ‘সেক্রেড গেমস’। ছবি: সংগৃহীত

অবশ্য বিপদও আছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহামারি ও লকডাউনের মতো কঠোর অবস্থা যখন শিথিল হতে শুরু করবে, তখন থেকেই ভিডিওস্ট্রিমিং ব্যবসায় ভাটার টান শুরু হতে পারে। আগে তো জীবিকা, তারপর না হয় বিনোদন! স্বাভাবিকভাবেই তখন মানুষ জীবন-জীবিকা গোছাতেই বেশি মনোযোগী হবে। তখনই ভিডিওস্ট্রিমিংয়ে মন্দা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যাপল, আমাজনের মতো টেকজায়ান্টদের তৈরি ভিডিওস্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান তখন বেশি সুবিধা পাবে। কারণ, এদের আছে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার। সে ক্ষেত্রে নেটফ্লিক্স আবার বিপাকে পড়তে পারে।

শঙ্কার উল্টো পিঠেই আশা থাকে। নেটফ্লিক্সের আছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গ্রাহক। আর আছে সংখ্যা ও মানে সবচেয়ে বেশি কনটেন্ট। এসব অস্ত্রেই স্ট্রিমিংওয়ারের এন্ডগেমে বাজিমাত করতে পারে নেটফ্লিক্স। হাজার হোক, ময়দানের সবচেয়ে পুরোনো খেলোয়াড় তো! অভিজ্ঞতা ও কৌশল—দুই-ই আছে।

তথ্যসূত্র: ভ্যারাইটি, দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, দ্য ভার্জ ও সিএনবিসি