কথা হোক, সুর হোক, গান হোক

গীতিকবি আসিফ ইকবাল। ছবি: ফেসবুক থেকে
গীতিকবি আসিফ ইকবাল। ছবি: ফেসবুক থেকে

চেনা জীবনে এক অচেনা অনিশ্চিত সময় পার করছি আমরা গানের মানুষেরা। ঘরবন্দী সময়ে মনবন্দী হয়ে পড়েছি সবাই। কেমন যেন এক মন খারাপ আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাদের সবাইকে। মন ভালো রাখার জোর চেষ্টা চলছে, কিন্তু কোথায় যেন নিরন্তর তাল কাটছে। এ সময়ে কেউ যে গান করবে তা কীভাবে? একে তো কারোরই মন ভালো নেই, তার ওপর একেকজন একেক জায়গায়। এক হতে পারছে না কেউ।

অনেকের নিজের রেকর্ডিং স্টুডিও নেই, কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভালো যন্ত্রীদের অনেকেই ঢাকার বাইরে, অন্যদিকে দেখা ছাড়া শুধু গান শোনার দিন শেষ হয়ে গেছে সেই কবে। শ্রোতা-দর্শকদের জন্য তৈরি করার মতো প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ক্যামেরা, লাইট, এডিটিং হাউস—এগুলো বন্ধ থাকার কারণে গান তৈরির ক্ষমতা হয়ে পড়েছে সীমিত। তাই হাতে গোনা যে কাজ হয়েছে, তা হয় আগে করা ছিল, না হয় ঘরে বসেই রেকর্ড করে বানানো। এ গানগুলোর মধ্যে কতগুলো আসলে কালোত্তীর্ণ হবে বা আদৌ হবে কি না, সে শুধু আগামীই বলতে পারবে।

আব্দুল আলিম, সত্য সাহা, সমর দাস, খন্দকার নূরুল আলম, খান আতাউর রহমান, সুবল দাস, সুধীন দাস, বারীণ মজুমদার, অজিত রায়, আজাদ রহমান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, সুবীর নন্দী, লাকি আখান্দ, হ্যাপি আখান্দ, আইয়ুব বাচ্চু, মনসুর আহমেদ, শাহনাজ রহমতুল্লাহ, শাম্মী আখতার, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সোহরাব হোসেন, আমজাদ হোসেন, নজরুল ইসলাম বাবু, হেনা ইসলাম, হেদায়েত হোসেন, বশির আহমেদ, মিনা বশির, প্রণব ঘোষ, দেবু ভট্টাচার্য্য, শেফালী ঘোষ, শ্যাম সুন্দর, আনোয়ারুদ্দীন খান, আজম খান, মোহাম্মদ আলী সিদ্দীকি, ফিরোজ সাঁই, বশির আহমেদ, মাহমুদুন্নবী, নীলুফার ইয়াসমীন, প্রবাল চৌধুরী, বারী সিদ্দীকি, খালিদ হোসেন, শেখ ইশতিয়াক, খালিদ হাসান মিলু, আলী আকবর রূপু, সাবা তানির চলে যাওয়ায় মৌলিক গানের যে অপূরণীয় শূন্যতা বিরাজ করছে, তা এমনিতেই আমাদের গানকে দুর্বল করেছে। তাঁদের জায়গা পূরণের সেই প্রতিভা এখন কই?

গান হচ্ছে যূথবদ্ধ কলা, কালেকটিভ আর্ট। সামাজিক দূরত্ব আর অভ্যাস বদলের দুরূহ সময়ে এ কাজ কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই করেছেন। মনে পড়ছে শিল্পী মমতাজ ও কুদ্দুস বয়াতির করোনা সচেতনতামূলক গান, কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় আসাদুজ্জামান নূরের পাঠ সঙ্গে নকিব খানের চার লাইনের গান, সোমেশ্বর অলির কথায় বেলাল খানের সুরে বিবিধ শিল্পীর গাওয়া গান, ১২৫ জন ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণে আমার লেখা অদিতের সুরে গান 'এসো সবাই', বিবিধ শিল্পীর গাওয়া গান 'দেব পাড়ি এ আঁধার' গায়িকা সামিনা চৌধুরী আর তাঁর ছেলে বীরবলের তৈরি 'কেউ যাব না বাইরে এখন আর' আর চিরকুটের অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর গান যা বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড কনটেন্ট হিসেবে এসেছে। এপার-ওপার বাংলার শিল্পীদের নিয়েও একটা কাজ চোখে পড়েছে, যেখানে আসিফ আকবর আর ইমরান গেয়েছেন। এ গানগুলো ভবিষ্যতে করোনা বিশ্বমারীর গান হিসেবে উচ্চারিত হবে বলেই আমার ধারণা। 'নতুন আলোয় নতুন ভোর আসবেই' শিরোনামে একটি গান প্রকাশ পেয়েছে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে। কবির বকুলের কথায় গানটি সুর ও সংগীত করেছেন খৈয়াম সানু সন্ধি। গানটিতে কন্ঠ দিয়েছেন তানভীর আলম সজীব, ইমরান মাহমুদুল, ডি রকস্টার শুভ, সাব্বির জামান, কিশোর দাস, সন্ধী, অটোমনাল মুন, দিলশাদ নাহার কনা, এলিটা করিম ও সভ্যতা। গানের ভিডিও দৃশ্যে আরও দেখা গেছে নোবেল, ফেরদৌস, চঞ্চল চৌধুরী, মীর সাব্বির, রোশান, বাঁধন, বিদ্যা সিনহা মিম, শানু, শবনম ফারিয়া, ঐশী, স্পর্শিয়া, পূজা চেরী প্রমুখকে। গানটি আছে প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পাতায়।

আমরা যে অবস্থায় গান করলাম আবার সীমিত পরিসরে ভিডিও করলাম, এটা অনেকের কাছে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মনে হয়েছে। গানে সেই প্রাণটা খুঁজেছে সবাই এক ধরনের বুক ধুকধুক নিয়ে। এভাবে বেশি দিন টিকে থাকা কঠিন। আশা করি আবার আগের ছন্দে ফিরতে পারব আমরা, এমন কথা আমি অনেক গানের মানুষকেই বলতে শুনেছি। জীবন যখন প্রশ্নের সম্মুখীন, বিনোদন তখন উদ্দেশ্যহীন। এ কথা শিল্পীরা যেমন অনুধাবন করেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে দর্শক আর শ্রোতারাও অনুধাবন করেছেন।

ফিডব্যাকের পুরোনো গান নতুন করে ফিরেছে। ছবি: সংগৃহীত
ফিডব্যাকের পুরোনো গান নতুন করে ফিরেছে। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্জালের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিল্পীরা নিজেরা মিলে ফেসবুক বা মেসেঞ্জার গ্রুপে এক হয়ে অনেক লাইভ শো করেছেন, করছেন। এটার চল ছিল না, সময়ের প্রয়োজনে এটা হলো। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে গানের অনুষ্ঠান করছে। ঈদেও যে এই ধারা অব্যাহত থাকবে, তা বলাই যায়। এই ধারাটা আমাদের জন্যে নতুন এবং স্টেজ শোর বিকল্প হিসেবে আপাতত অনেকেই মেনে নিচ্ছেন। নাটক এবং শুটিং বন্ধ, তারকারা নিজেরাও চাইছেন না বাইরে বেরুতে, এমন সময়ে তাঁরা নিজেরাও এই বিকল্পের ওপর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঝুঁকছেন।

ঈদে আসবে না আসবে না করেও অনেক গান কিন্তু আসছে। এ যেন অন্ধকার ভেঙে আলো আনার তীব্র চেষ্টা। এ সময়টা কেমন, বুঝলাম যখন শুনলাম দেড় যুগ আগের ফিডব্যাকের একটি গানও ফিরছে। ব্যান্ডের ওটু অ্যালবামে ছিল 'এই মন মানে না মানা' গানটি। ফোয়াদ নাসের বাবু ভাই জানালেন, গানটিতে সবাই নতুন করে বাজিয়েছেন, যাঁর যাঁর ঘরে বসে তৈরি করেছেন গানের ভিডিও। গানটিতে কণ্ঠও দেওয়া হয়েছে নতুন করে। গানটি আছে প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পাতায়।

আবার রেনেসাঁর পিলু খানের কুয়ালালামপুর থেকে সুর করে পাঠানো নতুন গান 'যখন যুদ্ধে আছি' মিউজিক করল সাজিদ সরকার ঘরে বসে। সে ই-মেইলে গান পাঠাল মাহাদী, এলিটা, পড়শী, মাহতিমকে। ওরা নিজেরা কণ্ঠ দিয়ে ও ভিডিও করে পাঠাল সাজিদকে। সাজিদ মিক্স মাস্টার করে পাঠাল পরিচালক হিমিকে। হিমি নিজের ল্যাপটপে একাত্তর টিভির ফুটেজ জোগাড় করে বানাল গানের ভিডিও। এটাই এখন নিউ নরমাল!

‘এসো সবাই’ গানটিতে ১২৫ জন ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
‘এসো সবাই’ গানটিতে ১২৫ জন ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

নিজের যোগাযোগ থেকে জানলাম, এই ঈদে আরও আসছে আসিফ আকবরের 'প্রেম জল'সহ একক এবং দ্বৈত মিলিয়ে গোটা তিনেক গান, গানচিল থেকে অর্ণবের গানের ভিডিও 'চোরাকাঁটা', হাবিব তাঁর নিজের প্রযোজনা সংস্থা এইচডাব্লিউ প্রোডাকশন থেকে নিয়ে আসছে 'আমি ভাবি তুমি', সিডি চয়েস থেকে তাহসানের গান 'অদৃশ্য পরজীবী', গানচিল থেকে মিনারের ব্যয়বহুল গানের ভিডিও 'একটুখানি', গুণী নির্মাতা তানিম রহমানের পরিচালনায় কলকাতার ইশানের গাওয়া গানের ভিডিও 'বাড়ি যাব বাড়ি যাচ্ছি', সাউন্ডটেক থেকে মিনারেরই 'তোমার দখলে', ইমরানের গানচিল থেকে দেহতত্ত্ব গান 'কবর', সাউন্ডটেক থেকে 'ফিরে আয়', ধ্রুব মিউজিক থেকে 'হাসব আবার আমরা', সিএমভি থেকে 'বাবা', কনা-জুয়েলের 'তুমি আমি', তানজিব-পূজার ভারতের লাদাখে তৈরি ব্যয়বহুল ভিডিও 'ফানুস', ঐশীর 'হৃদয়ে পোষা ধন', লেজার ভিশন থেকে বেলাল খানের গানের ভিডিও 'ডানা ছাড়া পাখি', মাহতিম সাকিবের গানচিল থেকে 'জিজ্ঞাসা', সাউন্ডটেক থেকে 'ভুলেছি তোমার ঠিকানা' আর গানচিল থেকে মাহাদীর 'কুসুমের গন্ধ হয়ে' সহ অনেক গান আসছে বা আসবে বলে শুনছি। তবে অতীতের যেকোনো সময় থেকে এবারের ঈদে গানের সংখ্যা অনেক অনেক কম। আর গানগুলো কেমন হবে, তা গান অবমুক্ত হওয়ার পরই বলা যাবে। এর মধ্য থেকে কটি গান বেরিয়ে আসবে, তাও নির্ধারণ করবে সময়।

সীমাবদ্ধতার জালে আটকে পড়া গানের ভিডিওগুলো কতটুকু দর্শক টানবে, বা করোনাবন্দী সময়ে করোনার খবরে ছেয়ে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতে গানের অ্যাপসগুলোর ওপর নির্ভর করে শ্রোতারা আবার গান শোনায় ফিরবেন কি না, তা দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই থাকলাম। তবে সংখ্যায় কম হলেও মনে হচ্ছে এবারে গান হবে হৃদয় থেকে। কথা হোক, সুর হোক, গান হোক। বেঁচে থাকুক গান, বেঁচে থাকুক গানের শিল্পীরা শ্রোতার হৃদয়ে সময়ে, অসময়ে এই প্রার্থনা গানের মানুষ হিসেবে আমাদের সবার।