স্কুল-কলেজ পালিয়ে দেখা সিনেমাগুলো

‘স্বপ্নের পৃথিবী’: ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবির পোস্টার।
‘স্বপ্নের পৃথিবী’: ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ ছবির পোস্টার।

সে এক সময় ছিল বটে! ছাদে মাইক বেঁধে টু স্ট্রোক টেম্পো ঘুরত গ্রামে গ্রামে। সে মাইকে ভেসে আসত মাজহারুল ইসলামের ব্যারিটোন কণ্ঠ, ‘চলিতেছে, চলিতেছে। আপনার পাশের প্রেক্ষাগৃহে চলিতেছে…।’ আমরা শুনতাম। কথা শেষ হতেই নাম বলা সিনেমাটির জনপ্রিয় একটি গানের কিছু অংশ বাজানো হতো। তারপর নায়ক কিংবা ভিলেনের গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। আর বৈশাখ মাসের রোদঝলমলে দুপুরগুলো আমাদের কাছে বড্ড বিষণ্ন মনে হতো তখন।

একে তো ছোট মানুষ। তার ওপর গ্রামের স্কুল বলে টিফিনের টাকা নেই। তাই টাকা বাঁচিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়ারও উপায় ছিল না। অগত্যা বাগানের বাঁশ কেটে বিক্রি করার এক মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকা। অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আবার একদিন টেম্পো আসত। আবার আমরা শুনতাম কোনো এক লাস্যময়ী নায়িকার নাম কিংবা কোনো এক ‘নটোরিয়াস’ ভিলেনের ব্যাপক কূটচালের গল্প বিনোদন-বন্ধু মাজহারুল ইসলামের ব্যারিটোনে। তারপর ভীষণ বিদ্রোহী হয়ে একদিন বাগানের বাঁশ কেটে ফেলে ১০০ টাকার ব্যবস্থা করা। অতঃপর ‘যা থাকে কপালে’ বলে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরা এবং যথারীতি এক বেলার ভাত বন্ধ কিংবা বাঁশের কাঁচা কঞ্চির শপাত শপাত!


এভাবেই দেখে ফেলা হয়ে গিয়েছিল ‘রং চটা জিনসের প্যান্ট পরা’ নামের ব্যাপক হিট গানটি যে সিনেমার, সেই ‘উত্থান পতন’ সিনেমাটি ১৯৯২ সালের। নায়ক রুবেলের কুংফুর কারিশমা সেই প্রথম দেখা।

‘পালাবি কোথায়’: বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি।
‘পালাবি কোথায়’: বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছবিটি।

গত শতকের পুরো নব্বইয়ের দশক পত্রিকার পাতার বিজ্ঞাপন, বাংলাদেশ বেতারের (তখন রেডিও বাংলাদেশ) বিজ্ঞাপন তরঙ্গ আর রোদজ্বলা দুপুরের ছাদে মাইকওয়ালা টেম্পো আমাদের জ্বালিয়ে মেরেছিল। নব্বইয়ের দশকের ক্ল্যাসিক ফ্যাশন লম্বা চুলের ওমর সানী নাকি ‘লাভার বয়’ সালমান শাহ, নটোরিয়াস হুমায়ুন ফরিদী নাকি ‘কমেডি কিং’ এ টি এম শামসুজ্জামান—এ প্রশ্নে আমরা সবে দুই ভাগে বিভক্ত হতে শুরু করেছি। সে কী উত্তেজনা! তখন পরিচালক দেখে সিনেমা দেখা হতো না। কোন সিনেমার গান কত মেলোডিয়াস, কত হিট আর কোন নায়ক ও ভিলেন আছে সিনেমায়, সেটা দেখে ঠিক করা হতো সিনেমাটি দেখা হবে কি হবে না। তখন আমরা নায়িকাদের খুব একটা পাত্তা দিতাম না। গান আর নায়ক-ভিলেন পছন্দ না হলে বাগানের বাঁশ খরচ করে লাভ কী!

১৯৯২-৯৩ সালে অনেক সিনেমা দেখা হলো। কিন্তু এখন মনে হয়, সিনেমা দেখার শুরুটা হয়েছিল আমাদের ১৯৯৪ সাল থেকে। ওমর সানী-মৌসুমী অভিনীত ‘দোলা’ (১৯৯৪) একটা নাড়া দিয়েছিল আমাদের। একটু অন্য রকম রোমান্টিক ছবি। ঝাঁকড়া চুলের ওমর সানী যখন নায়িকার জন্য কাঁদছেন, তখন দর্শক সারিতে বসা আমাদেরও দুচোখে প্লাবন ডাকছে। অনেক দিন পর ২০১৮ সালের দিকে ওমর সানী-মৌসুমী জুটির একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ওমর সানীকে এ কথা বললে তিনি এক্সট্রা একবার হ্যান্ডশেক করেছিলেন আমার সঙ্গে! আর মৌসুমী বিলোল কটাক্ষে তাকিয়েছিলেন। আমার বুকের মধ্যখানে তখন বেজে চলেছিল ‘তুমি সুন্দর, আমার অন্তর/ তুমি যে আমার সাধনা…’। ‘দোলা’ সিনেমার গানগুলো ছিল অসাধারণ সুন্দর। কথা ও সুর ছিল চমৎকার। এর পরের বছরই মুক্তি পেয়েছিল এই জুটির ‘আত্ম অহংকার’।

‘সত্যের মৃত্যু নেই’: সালমান শাহর শেষ জীবনের আলোচিত একটি ছবি।
‘সত্যের মৃত্যু নেই’: সালমান শাহর শেষ জীবনের আলোচিত একটি ছবি।

১৯৯৪ সালেই এসেছিল হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত ‘ঘাতক’ সিনেমাটি। অভিনয়ের কিছু না বুঝলেও তখন ঘাতক দেখে মনে হয়েছিল, এই লোকটির সব সিনেমা দেখতে হবে। দেখেওছিলাম মনে হয় প্রায় সব সিনেমা। স্কুলের শেষ ক্লাসে পড়ার সময় ‘বিশ্ব প্রেমিক’ (১৯৯৫) দেখে রাস্তায় আমরা দল বেঁধে গাইতাম ‘তোমরা কাউকে বোলো না,/ এই তো প্রথম একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে/ পাগল করেছে, আমায় জাদু করেছে।’


হুমায়ুন ফরীদির সব ছবিই ছিল হিট আসলে। ‘লম্পট’ (১৯৯৬), ‘মায়ের অধিকার’ (১৯৯৬), ‘পালাবি কোথায়’ (১৯৯৭), ‘ভণ্ড’ (১৯৯৮)। ‘মায়ের অধিকার’ সিনেমার ‘পিঁপড়া খাবে বড় লোকের ধন’ গানে গলায় হারমোনিয়াম ঝোলানো হুমায়ুন ফরীদির পারফরম্যান্স দুর্দান্ত ছিল। সিনেমার নামের কথা ভুলে গেলেও আর একটি চমৎকার গানের কথা মনে পড়ছে ‘তেল গেলে ফুরাইয়া, বাত্তি যায় নিভিয়া/ কী হবে আর কান্দিয়া।’ টেলিভিশন নাটকের ফরীদি আর সিনেমার ফরীদি যে দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা, নব্বইয়ের বাংলা সিনেমা না দেখলে বোঝা দায়।

‘ভণ্ড’: ‘ভণ্ড’ ছবিটিও ব্যবসাসফল ছবি।
‘ভণ্ড’: ‘ভণ্ড’ ছবিটিও ব্যবসাসফল ছবি।

কুলি (১৯৯৭) সিনেমার কথা না বললে পাপ হবে। নতুন নায়িকা পপি এলেন এ সিনেমায়। ‘কুলি নাম্বার ওয়ান’ নামের হিন্দি সিনেমার কপিরাইটে বানানো সিনেমাটি ছিল আক্ষরিক অর্থে ‘প্রণয়ধর্মী হাস্যরসাত্মক’ চলচ্চিত্র। নায়িকার কৃপণ বাপের ভূমিকায় হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় এখনো ভোলা যায় না। সৈয়দপুর শহরের লিবার্টি সিনেমা হল সেদিন ছিল হাউসফুল। ঠেলতে ঠেলতে হলে ঢুকে বাদামের ঠোঙা হারিয়ে শার্ট খুলে শরীরের ঘাম মোছার কথা এখনো ভুলতে পারি না। ‘কুলি’ এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।


শুধু এই সিনেমাগুলোই কি? না, আরও ছিল। না দেখা সিনেমা বাদ দিলেও হলে বসে দেখা সিনেমার মধ্যে ‘আম্মাজান’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘সিপাহী’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘সন্ত্রাস’, ‘আখেরী হামলা’, ‘চাঁদনী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘টাকার পাহাড়’, ‘টাকার অহংকার’, ‘মৌসুমী’, ‘এই ঘর এই সংসার’ প্রভৃতি বেশ কিছু নাম লেখা যায়, যেগুলো ছিল তখনকার হিট সিনেমা। কোনো কোনোগুলো ছিল সুপার ডুপার হিট।

১৯৯৮ সালের দিকে মান্না তখন রীতিমতো হিরো। মিশা সওদাগর ভিলেন, ডলি জহুর মা, দিলদার কমেডি কিং, রাজ্জাক তখন বাবা। প্রথমবার উচ্চমাধ্যমিক ফেল করে সোজা গিয়ে ঢুকেছিলাম ‘শান্ত কেন মাস্তান’ দেখতে। পুরো তিন ঘণ্টা পরীক্ষা ফেলের চিন্তা কোথা দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল টের পাইনি। এরপর অবশ্য আর সিনেমা দেখার সেই উত্তেজনা থাকেনি বিভিন্ন কারণে। ‘টাইটানিক’, ‘র‌্যাম্বো’, ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’-এর মতো সিনেমা তখন দেখে ফেলেছি আমরা সিনেমা হলে বসে। জ্যাকি চ্যানের মার্শাল আর্ট কিংবা ব্রুস লির পুরোনো সিনেমাও তখন দেখাত সিনেমা হলে। আর শুরু হলো কাটপিস। এল সিডির যুগ। বাংলা সিনেমার দিনও গেল।


ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টরেন্ট আর বিভিন্ন প্রাইম চ্যানেলের দুনিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে স্কুল-কলেজ পালিয়ে দেখা সিনেমাগুলোর খোঁজ পড়ল। ঝকঝকে হাই ডেফিনিশন বা ব্লু রে প্রিন্টের দাপটের এই সময়ে নব্বইয়ের দশকের সিনেমাগুলোকে ‘আলকাস মার্কা’ মনে হবে। কিন্তু আমাদের প্রথম যৌবনের উত্তাল দিনগুলোর হুমায়ুন ফরীদি বা এ টি এম শামসুজ্জামানের সেই দারুণ দারুণ সংলাপ, দিলদারের অতিরঞ্জিত কমেডি, নতুন-পপি-মৌসুমী-শাবনূরের কোমর দোলানো নাচ কিংবা অমল বোসের ‘অসুর মার্কা’ হাসি অথবা আনোয়ার হোসেনের বার বার মৃত্যু, আনোয়ারা ও ডলি জহুরের চোখের জল, রুনা লায়লা-এন্ড্রু কিশোর-সাবিনা ইয়াসমিন-কনক চাঁপা, আব্দুল হাদীর মেলোডিয়াস গান— এখন আর হবে না। করোনাকালের এই অযাচিত অবসরে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে তাই নব্বইয়ের জলসা মনে পড়ে।