একমুঠো মুগ্ধ অঞ্জন

অঞ্জন দত্ত। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
অঞ্জন দত্ত। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

আমাদের যাদের যৌবন শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে, তারা বহু নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ শুনে। নীলচে পাহাড়ের কোল থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত সরল মানুষের মহানাগরিক কোলাহলে ডুবে যাওয়ার গল্প আমাদের মনে দাগ কেটেছে। ‘বেলা বোস’ শুনে বিহ্বল হয়েছি, না, প্রেমের গল্পে নয়, রাস্তার পাশের সস্তা কেবিনের দিনগুলো শেষে হয়ে লাল-নীল সংসারের গল্প শুরু হওয়ার আশ্বাসে ফোনের ওপারে চুপ করে থাকা কারও ব্যথাতুর গল্পের আভাস পেয়ে। ‘মেরী আন’ শুনে স্কুলদিনের প্রেমের গল্প মনে পড়ে বিনিদ্র রজনী কাটাননি, এমন মানুষ কম আছেন। কিংবা অঞ্জনের সেই ট্রেডমার্ক গান, পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেওয়ার গল্প ছিল নব্বইয়ের দশকে আমাদের ব্যাপক উদ্দীপনার দিনগুলোর প্রতিচ্ছায়া।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের ভালো লেগেছিল বৃষ্টির গান। তখন ছিল ফনিক্স সাইকেলের দিন। মফস্বল শহরের পিচঢালা রাস্তায় অঞ্জনের মতো কালো চশমা চোখে ভিজতে ভিজতে আমরা বেসুরো গাইতাম ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’। পুরো নব্বই অঞ্জন আমাদের মাতিয়ে রেখেছিলেন সুরে। তখনো আমরা টের পাইনি, শুধু গান নয়। অঞ্জন সিনেমাও করেন। যখন টের পেলাম, তখন অভিনেতা অঞ্জন এক অদ্ভুত মাদকতা সৃষ্টি করেছেন সেলুলয়েডে।

কী আছে অঞ্জনে, যার জন্য আমাদের এই মধ্য বয়সে এসেও তাঁকে নিয়ে দুছত্র লিখতে পারলে আত্মতৃপ্তি হয়? সম্ভবত জেদ। মধ্যবিত্ত বাঙালির চাঁছাছোলা জেদ। কিছু একটা হয়ে ওঠার, কিছু একটা করে ফেলার কিংবা জীবনটাকে নেহাত নিজের মতো করে দেখার দুর্মর জেদ। আর মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে গড়ে ওঠা জীবনের ট্যাবুগুলোকে চাবকাতে চাবকাতে সরিয়ে ফেলার মানসিকতা। সে জন্যই মনে হয় অঞ্জন প্রথম বাংলা সিনেমা বানিয়েছিলেন ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’, ২০০৪ সালে; তাঁর প্রথম সিনেমা ‘বড় দিন’ বানাবার পাক্কা ছয় বছর পর। ‘বড় দিন’ ছিল হিন্দি ভাষায় বানানো এবং পরিচালক হিসেবে অঞ্জনের প্রথম সিনেমা।

অঞ্জন দত্ত। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
অঞ্জন দত্ত। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

বো ব্যারাকস ফরএভারের গল্প গড়ে ওঠে পরিচয়ের সংকটে ভোগা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটিকে ঘিরে, দক্ষিণ কলকাতায় ছিল যাদের বসবাস। ইংরেজি বলতে পারা আর ব্রিটিশ রক্ত শরীরে থাকার এক মেকি এলিটিজমের চর্চা করা বো ব্যারাকসের চরিত্ররা ছিল মূলত খাঁচায় বন্দী পাখির মতো। পলেস্তারা খসে পড়া ঘিঞ্জির জীবন আর নিজেদের বাস্তবতার বাইরে যাদের বিলাসিতা বলতে ছিল অস্ট্রেলিয়া কিংবা দা গ্রেট ব্রিটেন যাওয়ার চিন্তা এবং গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের স্মতি হাতড়ানো। বাইরের বিপুল পরিবর্তন এই কমিউনিটিকে খুব ধীরে ধীরে বদলে দিতে থাকে। এখানকার তরুণেরা পথ খুঁজতে থাকেন ভীষণ পরিচয়ের সংকট থেকে উত্তরণের। এই উভয়সংকটে পড়া অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের রোজকার খুঁটে খাওয়া জীবন, যৌনতা, ড্রাগস, সুখ, দুঃখ সবকিছু নিয়ে এক অসাধারণ গল্প ছিল বো ব্যারাকস ফরএভার; অঞ্জন দত্তের গানগুলোর মতোই চিত্রধর্মী, জীবন্ত ও বাস্তব। এই সিনেমায় উপরি পাওনা ভিক্টর ব্যানার্জী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মুনমুন সেনদের মতো অভিনয়শিল্পীর একেবারে ভিন্নধর্মী অভিনয়।

এর আট বছর পর, ২০১২ সালে অঞ্জন দত্ত বানিয়েছিলেন ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’। সম্ভবত এখন পর্যন্ত এই সিনেমা অঞ্জন দত্তের বানানো সেরা সিনেমা, যদিও কলকাতার সংবাদমাধ্যমে ছিল এর মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বো ব্যারাকস ফরএভার আর ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’–এর মাঝখানে অঞ্জন বেশ কিছু সিনেমা বানিয়েছেন, অভিনয়ও করেছেন অনেক সিনেমায়। বানানোগুলো হলো ‘দা বঙ কানেকশন’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’, ‘চলো, লেটস গো’, ‘চৌরাস্তা’, ‘ব্যোমকেশ বকশী’, ‘মহানগর কোলকাতা’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’, প্রায় পরপর প্রতিবছর। তাহলে বো ব্যারাকস ফরএভার আর দত্ত ভার্সাস দত্তের তুলনা কেন?

ঠিক তুলনা নয়। রঞ্জনা আমি আর আসব না (২০১১) সিনেমায় অঞ্জন দত্ত গান নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা বলে ফেলেছিলেন। এবং সম্ভবত জীবন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনাগুলোও। সেখানে মেকি এলিটিজমের বালাই নেই। এরপরে যতগুলো সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন, তাতে রঞ্জনা আমি আর আসব নার বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কিন্তু বো ব্যারাকস ফরএভার-এ মেকি এলিটিজমের বিরুদ্ধে অঞ্জন যে কথা বলতে শুরু করেছিলেন, দত্ত ভার্সাস দত্ততে সেটার যথোপযুক্ত যতি পড়েছে। প্রথমেরটা ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে, পরেরটা বাঙালি মধ্যবিত্ত নিয়ে। এই সিনেমা অঞ্জন দত্তর সেমিবায়োগ্রাফি।

২০১২ সালে অঞ্জন দত্ত বানিয়েছিলেন ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’
২০১২ সালে অঞ্জন দত্ত বানিয়েছিলেন ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’

এক অসফল আইন ব্যবসায়ী বীরেন দত্তের যৌথ পরিবারকে ঘিরে উনিশ শ সত্তরের দশকের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’–এর কাহিনি। তখন দুই বাংলাই অশান্ত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে। আর পশ্চিম বাংলা লড়ছে জাতীয় ইমার্জেন্সিতে। এই টালমাটাল সময়ে ভাঙতে থাকা মধ্যবিত্ত বীরেন দত্তের পরিবারে চলতে থাকে এজমালি শরিকি ছাদ নিয়ে ভাগাভাগির লড়াই, ভাইয়ে ভাইয়ে। চলতে থাকে ‘সাবেক কালের বড়মানুষির ভগ্নদশা’ মেনে নিতে না পারা এক অসহায় বাবার অন্তর্গত ইগোর ভাঙা–গড়া—দার্জিলিংয়ের সেন্ট পলস স্কুলের মাইনে দিতে না পেরে যার ছেলে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল বাড়িতে।

কথায় কথায় মুখ্যমন্ত্রীর নাম নেওয়া দত্তবাড়ির মেজ ছেলে বীরেন দত্ত টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিচ্ছবি যে নিজের ব্যার্থতাকে সফল করার জন্য বেছে নেয় নিজের পুত্রসন্তানকে। তারপর পারিবারিক নাটকীয়তা এবং সেই নাটকীয়তার শেষে জন্ম নেয় এক অদম্য তরুণ যে হয়ে ওঠে অভিনেতা।

দত্তবাড়ির তিন প্রজন্মের গল্প ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’। অর্থনীতি আর সময়ের কাছে পরাজিত, লাগামহীন ব্যর্থতার হতাশায় ডুবে যাওয়া মদ্যপ, পরনারীতে আসক্ত, কাবুলিওয়ালার কাছে ধার করে সংসার চালানো কিন্তু ভেতরে–ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া এক অসহায় বাবার গল্প দত্ত ভার্সাস দত্ত। আবার অন্যদিকে প্রথায় গা ভাসিয়ে না দেওয়া, প্রবণতাকে আঁকড়ে ধরতে না চাওয়া এক তরুণের জীবনকে নতুন করে নির্মাণ করারও গল্প এটি।

২০১২ সালে ভারতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’
২০১২ সালে ভারতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র রিভিউয়ে ১০–এর মধ্যে ৯ পাওয়া এ সিনেমায় অঞ্জন দত্ত, রণদীপ বোস, অর্পিতা চ্যাটার্জি, কৌশিক সেন, শঙ্কর চক্রবর্তী, দীপঙ্কর দে, রূপা গাঙ্গুলী, শ্রীজিত মুখার্জি প্রমুখের দুর্দান্ত অভিনয় মন কেড়ে নেবে দর্শকের, কোনো সন্দেহ ছাড়াই।

১৯৯৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অঞ্জন দত্ত বানিয়েছেন ২৩টি সিনেমা, একটি হিন্দি সিনেমাসহ। এগুলোর মধ্যে একটি সিনেমার কথা বলতেই হয় আলাদা করে, ‘ম্যাডলি বাঙালি’ (২০০৯)। একটি গ্যারেজকে কেন্দ্র করে একদল তরুণের ধর্ম-জাতপাত ভুলে একটি গানের দল গড়তে চাওয়ার গল্প। ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ সিনেমার আগে গান এবং আধুনিক গান নিয়ে যদি কিছু বলে থাকেন, সেটা এই সিনেমায়।

২০১২ সালে ভারতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ সিনেমা অবশ্যই আমাদের চোখে লেগে থাকবে তার বক্তব্য আর গানের জন্য। কিন্তু ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’ আমাদের মনে থাকবে সবকিছু ছাপিয়ে।