আমি অনুসরণ করতাম হেমন্তের প্রক্ষেপণ

১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঢাকায় সাদি মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৯ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঢাকায় সাদি মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

নন্দিত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদের প্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ ১৬ জুন, মঙ্গলবার। এদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে চ্যানেল আইতে সরাসরি গান ও স্মৃতিচারণা করবেন তিনি। প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে নানা স্মৃতি প্রথম আলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করলেন তিনি।

বাড়িতে কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন?
অনলাইনে গানের ক্লাস নিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা, বাড়ির লোকজনকে রান্নাবান্না করে খাওয়াতেই সময় চলে যাচ্ছে। শিগগিরই হয়তো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও নিতে শুরু করব।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল আপনার?
১৯৭৭ সালে যখন শান্তিনিকেতনে পড়ি, আমার গুরু মোহর দিদি (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। কলকাতার রবীন্দ্রসদনে একটা অনুষ্ঠানে গান করতে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আমরা গিয়েছিলাম শুনতে। মোহরদি বলেছিলেন, “হেমন্ত বাবু, আমার প্রিয় এ ছাত্রটি আপনার খুব ভক্ত, বাংলাদেশের ছেলে। গাইতে গিয়ে আপনাকে খুব অনুসরণ করে।” বাংলাদেশের কথা শুনে তিনি যেন দুর্বল হয়ে পড়লেন। অবাক হয়ে বলেছিলেন, “তোমার ছাত্র আমাকে অনুসরণ করে কীভাবে?” সেদিনই প্রথম তাঁকে সামনে থেকে গাইতে দেখি। প্রথমে গ্রিন রুমে গিয়ে ফলো করছিলাম তিনি কীভাবে গান করেন, তারপর মঞ্চে গাইতে শুনে আমি তো মুগ্ধ।

আপনি সত্যিই তাঁকে অনুসরণ করতেন?
তাঁর গলাকে নয়, আমি অনুসরণ করতাম হেমন্তের প্রক্ষেপণ। কণ্ঠ ঈশ্বরপ্রদত্ত। ঈশ্বর যাঁকে যেমন কণ্ঠ দেন, তাঁর সেই গলা নিয়েই গাইতে হয়। আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো স্পষ্ট করে উচ্চারণ করার চেষ্টা করি। অনেককে বলতে শুনেছি, সাদির উচ্চারণ সুন্দর। আমি কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই সেটা শিখেছি। তাঁর গান শুনে আমি এখনো শিখি।

তাঁর গানের সঙ্গে পরিচয় কোন বয়সে?
ছোটবেলা থেকেই আমি তাঁর গান শুনি। বাড়িতে একটা মারফি রেডিও ছিল। তাতে সব ধরনের গান শোনা হতো। ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলি’ ও ‘শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি’ গান দুটি গুনগুন করে সব সময় গাইতাম। মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে লুট করা অস্ত্র পাহারা দিতাম যে ঘরটায়, সেখানে বসে একটা ট্রানজিস্ট্রারে আগরতলা বেতার শুনতাম। আগে হেমন্তের কণ্ঠে আধুনিক গান শুনলাম, আর তখন শুনলাম রবীন্দ্রসংগীত, ‘এই কথাটি মনে রেখো’, ‘শুধু তোমার বাণী নয় হে বন্ধু’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’। এত স্পষ্ট করে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া যায় ভেবে অবাক হয়ে যেতাম। তখন থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথের প্রতি প্রেম জাগে।

বাড়ির বারান্দায় বসে বই পড়েন শিল্পী সাদি মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত
বাড়ির বারান্দায় বসে বই পড়েন শিল্পী সাদি মহম্মদ। ছবি: সংগৃহীত

আপনার শিল্পী হওয়ার পেছনে তাঁর একটা সূক্ষ্ম প্রভাব আছে?
হয়তো। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমি হিট গায়ক ছিলাম। না জেনেই হিট! পরে পড়াটা শেষ করা হলো না। বৃত্তি নিয়ে শান্তিনিকেতন চলে যেতে হয়েছিল। বাবা শহীদ হওয়ার পর আমরা গরিব হয়ে গিয়েছিলাম। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের পড়ার খরচ জোগাড় করতেন। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ইঞ্জিনিয়ার হব, শিবলী ডাক্তার। আমরা দুজন বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি।

শুনেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এসে আপনার গান শুনতে চেয়েছিলেন?
হ্যাঁ, ১৯৮৯ সালে তিনি মারা যাওয়ার ১১ দিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় ফেরার ফ্লাইট। বললেন, মোহরের ছাত্রছাত্রীর গান শুনব। লোক মারফত ফোন করে আমাদের ডেকে পাঠালেন। আমি আর বন্যা (রেজওয়ানা চৌধুরী) গেলাম। দুজনে ডুয়েট ও একক কণ্ঠে গান শোনালাম। আমি দুটো হারানো দিনের গান ‘গায়ের বধূ’ ও ‘আর কত রহিব পথ চেয়ে’ গাইলাম। তিনি বললেন, এটা যেন কার গান? আমি বললাম, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুর ও গৌরীপ্রসন্নের লেখা এ গানটা ১৯৫৬ সালে আপনিই গেয়েছিলেন। তিনি বললেন, “তুমি আমার এত খবর রাখো?” আমি বলেছিলাম, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনার সঙ্গে আমার বাবার চেহারার অনেক মিল। তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন, আমি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ঘরটায় একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন। হঠাৎ ফ্ল্যাশ বাতি জ্বলে উঠতেই তিনি উঠে বসলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে ফটোগ্রাফারকে বললেন আমাদের ছবি তুলে দাও।

বাংলা গানে তাঁকে আমরা কোন আসন দেব?
তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে আমরা একটু একটু করে মধু আহরণ করছি। তিনি নিজে সুর করে অন্যকে গাইয়েছেন, অন্যের সুরে নিজে গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গানকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। এ রকম শিল্পী কমই আছেন যাঁরা একাধারে সিনেমার গান, আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে মানুষের মন কেড়ে নিয়েছেন।