শাহিন খান এখন পুরোদস্তুর চাকরীজীবী

শাহিন খান। ছবি: সংগৃহীত
শাহিন খান। ছবি: সংগৃহীত

একমাত্র মেয়ে বসুধা থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন গত বছর। শাহিন খান থাকেন ঢাকার লালমাটিয়ায়। এক মাসের জন্য বাবার কাছে এসেছিলেন মেয়ে। করোনার কারণে আটকে গিয়ে তা ঠেকেছে পাঁচ মাসে। বাবা-মেয়েকে একসঙ্গে বেধে রেখেছে করোনা। বাসার কাছেই অফিস শাহিন খানের। দুই মিনিটের হাঁটা পথ। অফিস শেষে সোজা ফেরেন বাসায়। সময় দেন মেয়েকে।

বর্তমানে মীনাবাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিন খান। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেই চাকরিতে ঢোকেন। তার আগে ১৩ বছর কাটিয়ে আসেন প্রবাসে। ১৯৯৬ সালে দেশ ছাড়েন। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সময় শাহিন খান ছিলেন টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয় অভিনেতা। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে দর্শকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে সবার নজরে পড়েন।


হঠাৎ টিভি ক্যারিয়ার ফেলে চলে গেছেন বাইরে। ফিরেও এসেছেন এক যুগ পর। তারপর আর অভিনয়ে নিয়মিত হননি কেন? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হতে হয় শাহিন খানকে। সম্প্রতি 'প্রথম আলো'ও একই প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয় তাঁর কাছে। শাহিন খানের উত্তর হচ্ছে, ‘দেশে ফিরে আসার পর প্ল্যান ছিল অভিনয়টাই নিয়মিত করব। কিছু নাটক করার পর দেখলাম, ছিয়ানব্বইয়ে আমি নাটকের জগৎটাকে যেমন রেখে গেছি, তেমন আর নেই।’


অবস্থা কতটা পাল্টাল শোনা যায় শাহিন খানের মুখে, ‘ফিরে এসে দেখলাম শুধু টাকাপয়সা রোজগারের জন্য নাটক করা যেতে পারে। যদি অভিনয়টা আমার পেশা হতো, এটাকে নিয়ে যদি চলতে হতো, তাহলে নাটক আমি করতাম। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম না। যে কারণে আর উৎসাহ পাইনি। আমার চাকরিটাও প্রচুর সময় নেয়, নাটকের জন্য সময় আমি বের করতে পারি না।’


শাহিন খান শেষ অভিনয় করেছেন গত বছর। আফসানা মিমির নির্দেশনায় একটি জনসচেতনতামূলক নাটকে তাঁর শেষ অভিনয়। তারও আগে আফসানা মিমিরই নির্দেশনায় 'ডলস হাউজে' সিরিয়ালে অভিনয় করেন। সে–ও প্রায় চার–পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এখনো অভিনয়ের প্রস্তাব পান। কিন্তু সাড়া দেন না। টিভিতে যতটুকু মুখ দেখান তার উপলক্ষ ব্যবসা।


শাহিন খান বলেন, ‘আমি আসলে পর্দায় যদি যাই তো বিজনেস শোতে কথা বলতে। পত্রপত্রিকায় বা টেলিভিশনে আমার ডাক পড়ে রিটেইল বিজনেস নিয়ে কথা বলার জন্য। যেহেতু আমি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছি। আমার পরিচয় এখন অনেক বেশি বিজনেসের লোক হিসেবে।’ তিনি জানান, মিডিয়ার বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগ রয়েছে থিয়েটারের বন্ধুদের সঙ্গেও। নাটকের বিভিন্ন দলের সঙ্গেও কথাবার্তা হয়। কিন্তু অভিনয় আর করতে চান না। 

‘আসলে আমি অভিনেতা হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করি। অভিনেতা হিসেবে আমার সে রকম কোনো অর্জন আছে বলে আমি মনে করি না। শিল্পমাধ্যমে যে পরিমাণ সময় দিতে হয়, ডেডিকেশন দিতে হয়, সেভাবে একটা সময় আর ডেডিকেশন দিতে পারিনি আমি। এখান থেকে চলে গিয়ে দীর্ঘ এক যুগ পর দেশে ফিরে আসি। যেখানে চর্চার জন্য সময় দিতে পারব না, সেখানে অভিনয় না করাই ভালো। আজকে আমি যদি নাটক করতে রাজি হই, আমি জানি যথেষ্ট সময় দিয়ে আমি নাটকটি করতে পারব না। এ জন্য মনে হয় যে নাটক না করাই ভালো,’ সাফ কথা শাহিন খানের।

শাহিন খান। ছবি: সংগৃহীত
শাহিন খান। ছবি: সংগৃহীত

দর্শকেরা কেমনভাবে নিয়েছেন শাহিন খানের স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যাওয়াটাকে? তার উত্তর দেন শাহিন খান এভাবে, ‘ওই সময় যারা স্কুলে পড়ত, কলেজে পড়ত, এখন তারা মধ্য বয়সে চলে গেছে। তারা দেখা হলে বলে, ওই সময়ের নাটকগুলো ভালো ছিল। আমরা যেহেতু দুই ভাই একসঙ্গে কাজ করতাম, সেটাও বলেন। দর্শকদের কথায় কখনো খারাপও লাগে। খারাপ লাগে এই ভেবে যে নাটক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।’ ২০১৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর বড় ভাই জনপ্রিয় অভিনেতা খালেদ খান।


শাহিন খান একটা সময় ভাবতেন শুধু নাটকই করে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩ বছর পর ফিরে দেখেন বাংলাদেশে ত্রিশটার মতো চ্যানেল। কিন্তু নাটককে পেশা হিসেবে নেওয়া যায় না। শাহিন খানের মতে, নাটক এখনো ইন্ডাস্ট্রি হয়নি। কিছু লোকের পেশা হয়েছে। কিন্তু এ জন্য নাটককে তিনি ইন্ডাস্ট্রি বলতে নারাজ। যেকোনো ইন্ডাস্ট্রিতে প্রত্যেকের জীবিকার একরকম বন্দোবস্ত থাকে। এ দেশের নাটকের জগতে সেটা হয়নি। এখানে যেভাবে ফরমায়েশি কাজ হয়, সেই পরিবেশে নাটককে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি তিনি।


শাহিন খানের জবানে উঠে আসে তাঁর সময়ের কথা। ’৯৪–এর দিকে বাংলাদেশে প্যাকেজ নাটক শুরু হয়। তখন টেলিভিশনে বেশ ভালো প্রোডাকশন হতো। অনেক সময় নিয়ে নাটক নির্মাণ হতো। ৫–৭ দিন ধরে কাজ করা হতো। এক ঘণ্টার নাটক ৩–৪ লাখ টাকা খরচ করে বানানো হতো, ৬–৭ লাখ টাকায় বিক্রি হতো। স্বভাবতই কিছু ভালো নাটক তখন হয়েছে। বিটিভির কিছু নাটক তো ছিলই। যখন প্যাকেজ শুরু হলো বেশ কিছু ভালো নাটকে তখনো কাজ করেছি।


শাহিন খানের অভিনীত টিভি নাটকের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। যার মধ্য থেকে তাঁর প্রিয় তালিকায় 'প্রাকৃতজন', 'অজ্ঞাতবাস', 'কাঁটা', 'নিঃশব্দ ঘুণপোকা' ইত্যাদি। এগুলো প্যাকেজ নাটক। বিটিভির নাটকের মধ্যে তাঁর প্রিয় 'বাঘবন্দি' ও 'একাত্তরের রাতদিন'। মঞ্চে তাঁর প্রিয় কাজের মধ্যে প্রথম, নিউইয়র্কে মঞ্চায়িত 'নুরলদিনের সারাজীবন'। সেখানে আব্বাস চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।


১৯৮৬ সাল থেকে দেশ ছাড়ার আগপর্যন্ত মঞ্চে যুক্ত ছিলেন শাহিন খান। দেশে এসে থিয়েটারেও আর ফেরেননি। ‘অভিনয়টা আর করতে পারব বলে মনে হয় না। অভিনয়টা আমার কাছে ক্রিকেট খেলার মতো। আপনি যদি এখন সৌরভ গাঙ্গুলিকে খেলতে বলেন, তিনি কিন্তু পারবেন না। এটা নিয়মিত চর্চার বিষয়। আপনি যদি প্রতিদিন প্র্যাকটিস করেন তবেই বলের মুভমেন্ট বুঝতে পারবেন। ক্রিকেটের চর্চার মতো, থিয়েটারচর্চায় যতটা সময় দেওয়া উচিত তা দিতে পারিনি আমি।’