'এখন কিশোর কোনো কথা বলে না, চোখ বন্ধ করে থাকে'

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো

জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর স্ত্রীকে জানালেন, তাঁর শরীরে লিম্ফোমা ক্যানসার ফিরে এসেছে। এরপর তিনি আর সিঙ্গাপুর থাকতে চাননি। চিকিৎসকদের বলেন, তাঁকে যেন বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি জানান, দেশের মাটিতেই মৃত্যুবরণ করতে চান তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমনটাই জানিয়েছেন দেশের জনপ্রিয় এই শিল্পীর স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু।

এন্ড্রু কিশোরের দেশে ফেরার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। ১০ জুন টিকিটের বন্দোবস্তও করা হয়। এর মধ্যে হঠাৎ ২ জুন এন্ড্রু কিশোরের হালকা জ্বর আসে, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। জ্বরে কোনো ওষুধ তাঁর শরীরে কাজ করছিল না। তখন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জানা যায় তাঁর শরীরে লিম্ফোমা ক্যানসার আবার ফিরে এসেছে।

এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু জানালেন, যখন কোনো ওষুধে কাজ করছিল না, তখন হাসপাতালের ডাক্তার তাঁকে ফোন করে বলেন, এন্ড্রু কিশোরের প্যাট স্ক্যান করতে হবে, লিম্ফোমা আবার ব্যাক করেছে কি না দেখতে হবে।
লিপিকা বলেন, ‘আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছি, কারণ শুরুতে চিকিৎসক বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ফিরে আসে, তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে আসে আর খুব দ্রুত ছড়ায়। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। জুনের ৯ তারিখে প্যাট স্ক্যান হয় এবং সেদিন রাতে চিকিৎসক ফোন করে জানালেন, পরদিন সকাল ১০টায় আমার সঙ্গে প্যাট স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান।’

লিপিকা এন্ড্রু জানালেন, ৯ জুন রাত ছিল তাঁর জীবনের ভয়ংকর রাত। সারা রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। পরদিন সকাল ১০টার আগে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে গেলেন। স্বামী পাশে বসে রইলেন। এরপর চিকিৎসক ডাকলেন। চিকিৎসক কী জানালেন, শুনুন তাঁরই মুখে। ‘একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বলল ডাক্তার ডাকছেন।’ ডাক্তার লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললেন, ‘লিম্ফোমা ব্যাক করেছে। ডাক্তার বললেন, এন্ড্রুকে বলব?’ আমি বললাম, ‘বলতে তো হবে।’ ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার মনিটরের সামনে নিয়ে গেলেন, লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললাম, ‘এরপর কী?’ বললেন, ‘আমি দুঃখিত। আমার আর কিছুই করার নেই।’ ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’ বললেন লিপিকা এন্ড্রু।

স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রুর সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর, প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো
স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রুর সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর, প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে। ছবি: প্রথম আলো

এবার চিকিৎসক এন্ড্রু কিশোরকে জানালেন, তাঁর শরীরে লিম্ফোমা ক্যানসার ফিরে এসেছে। চিকিৎসকের কাছে এমন খবর শোনার পর আর এক মুহূর্তও সিঙ্গাপুর থাকতে চাইছিলেন না এন্ড্রু কিশোর। লিপিকা এন্ড্রু বলেন, ‘কিশোর ডাক্তারকে বলল, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কাল দেশে ফিরব। আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল। কিশোর দূতাবাসে ফোন করে বলল, কালই আমার ফেরার ব্যবস্থা করে দিন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকেলে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।’

গতকাল রোববার লিপিকা এন্ড্রু ফেসবুকে লিখেছেন, সৃষ্টিকর্তার কী খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ ফলাফল নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কত দিন, তিনি এটা লিখেছিলেন, এটা অনুমান করা বেশ কঠিন, হতে পারে এক মাস নয়তো বছর।

লিপিকা এন্ড্রু বলেন, ‘এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাবো, বলে কিছু না, পুরোনো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না। ক্যানসারের শেষ সময়টা খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।’

ফেসবুকে লিপিকা এন্ড্রু এ–ও লিখেছেন, ‘এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকব, মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নেবেন, সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন। আর এন্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’