আর ডি বর্মন বলেছিলেন, 'ঢাকাইয়া, তুই থেকে যা'

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ আর গায়কিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বলিউডে ক্যারিয়ার গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক রাহুল দেববর্মন। তাঁর সে প্রস্তাব নাকচ করেছেন এই শিল্পী। জীবিত থাকাকালে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেসব কথা বলেছিলেন এন্ড্রু কিশোর।

এন্ড্রু কিশোর জানান, সে সময় একটা যৌথ প্রযোজনার ছবি হয়েছিল, হিন্দি নাম ‘শত্রু’। বাংলায় ‘বিরোধ’। ওই ছবিতে আর ডি বর্মনের সুরে হিন্দি ও বাংলায় গান গেয়েছিলেন। স্মৃতিচারণা করে এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন, ‘যেদিন আমি দেশে ফিরব, সেদিন বিদায় নিতে গেলে পঞ্চমদা আমাকে বললেন, ‘ঢাকাইয়া, তুই হয়তো ভাবছিস, মাঝেমধ্যে ডাকব, গাওয়াব। কিন্তু আমাদের দেশাত্মবোধটা খুব বেশি। কিছু করতে চাইলে এখানে থাকতে হবে। তুই থেকে যা। বিয়েশাদি করিসনি। সে ব্যবস্থাও আমি করে দেব। কিন্তু আমি তখন তাঁকে বললাম, “দাদা, আমার দেশেই আমি অনেক ভালো আছি।”’ তিনি তখন আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘তুই একটা বাঘের বাচ্চা।’

সেবার নির্মিত হচ্ছিল বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘শত্রু’। মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার প্রমোদ চক্রবর্তীর পরিচালনায় এই ছবি। ওই ছবিতে গান গাওয়ার জন্য আমার ডাক পড়ল। শুনলাম, সংগীত পরিচালনা করবেন রাহুল দেববর্মণ। কারণ, রাহুল দেববর্মনের গান করা তো মহাভাগ্যের ব্যাপার! যা হোক, গান হবে মুম্বাইয়ে। তাই ভিসা নিতে গেলাম দূতাবাসে। এখানেই ঘটল বিপত্তি। কারণ, আমার তো ওয়ার্ক পারমিট নেই। ভিসা অফিসার জানতে চাইলেন কেন যাব মুম্বাইয়ে। আমি স্বগর্বে বললাম, রাহুল দেববর্মনের সুরে গান গাইতে যাব।

ভদ্রলোক প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। পরে আমার পুরো পরিচয় জেনে ভিসার ব্যবস্থা করলেন। একসময় হাজির হলাম মুম্বাইয়ে। সোজা প্রমোদদার বাসায়। আমার মাথায় তখন খেলছে কখন পঞ্চমদার (রাহুল দেববর্মনের ডাকনাম) সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। বিকেলে এল সেই মুহূর্ত। প্রমোদদার বাসা থেকে পঞ্চমদার বাসা হাঁটার পথ। ওই বাসায় গিয়ে দেখলাম বিশাল এক প্রাসাদ। সামনে সুপ্রশস্ত একটা বাগান। মানুষজন তেমন নেই। প্রমোদদা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে। বুঝলাম, অমায়িক ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি। ভদ্রলোক কেন জানি আমাকে পছন্দ করে ফেললেন। বললেন, ঢাকাইয়া, (আমাকে তিনি ঢাকাইয়া বলে ডাকতেন) তুই প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার বাসায় চলে আসবি। আমি কাজ করব, তুই দেখবি। কিছুটা অবাক হলাম। কারণ, একজন সংগীত পরিচালক কখনো তাঁর কাজের সময় অন্য কারও উপস্থিতি কামনা করেন না। বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে বললেন, এই হলো ঢাকাইয়া, ও যখন আসে দরজা খুলে দিবি, যা খেতে চায় খাওয়াবি। কয়েক দিন কাটল। আমি নিয়মিত ওনার বাসায় আসা-যাওয়া করলাম। এদিকে তিনি গানটা সুর করে ফেললেন।

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

রেকর্ডিংয়ের দিন তিনি গানটা কয়েক রকম করে গেয়ে শোনালেন। এরপর আমি গাইতে গেলাম। কিন্তু হিন্দি বলতে পারা আর হিন্দি গান গাওয়া তো এক কথা নয়। তা ছাড়া গানের কথাগুলো ছিল বেশ কঠিন। তাই আমার গাওয়াটা পরিষ্কার হচ্ছিল না। এবার পঞ্চমদা আমাকে নিয়ে গেলেন ওই গানের গীতিকারের বাসায়। সমুদ্রতীরবর্তী প্রাসাদসম ওই বাড়িতে থাকেন কিংবদন্তি গীতিকার আনন্দ বকশি, আমার গানটির রচয়িতা। দোতলা ওই বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে আমরা সোজা চলে গেলাম তাঁর বেডরুমে। ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছিলেন। ওনার পানের অভ্যাস। দেখি পানের বাটা সঙ্গে নিয়ে ঘুমুচ্ছেন। পঞ্চমদার ডাকে ঘুম থেকে উঠলেন। উঠেই মুখে পান দিলেন। এরপর জানতে চাইলেন ব্যাপার কী? প্রমোদদা বললেন, ব্যাপার কিছু না, তুমি কি কঠিন গান লিখেছ। কিশোর তো গাইতে পারছে না। তখন বকশিদা নিজে গানটি সুরে সুরে গাইলেন। বললেন, আমার হিন্দি উচ্চারণগুলো ভালো করে শুনে মার্ক করে নাও। সন্ধ্যায় গেলাম পঞ্চমদার বাসায়। এবার গাইলাম। প্রমোদদা তবু বললেন, ভালো গাইছ কিন্তু কোথায় যেন সমস্যা। পঞ্চমদা বললেন, কই না তো! ও তো ঠিকই গাচ্ছে। রেকর্ডিংয়ের দিন প্রমোদদা পঞ্চমদাকে বললেন, আশাকে ডাক (মানে আশা ভোসলে)। ও থাকলে সমস্যাটা কিশোরকে বুঝিয়ে বলতে পারবে।

এবার আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়তে শুরু করল। যা হোক, আশাজি এলেন, স্নেহভরা কণ্ঠে আমার পরিচয় নিলেন। কানের কাছে এসে আস্তে আস্তে আমাকে গানটা শোনালেন। সে কী মধুরতম কণ্ঠস্বর, মনে হয় তানপুরা থেকে আসছে জগৎখ্যাত কোনো সুর। আজও আমার কানে বাজে সেই সুর, কণ্ঠস্বর। আমাকে গানটা ধরিয়ে দিলেন। যেখানে যেখানে সমস্যা ছিল শুধরে দিলেন। এবার আমি গাইতে গেলাম। কিন্তু এবার আমি আর গাইতে পারছি না। গলা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। তখন পঞ্চমদা-আশাজি হাত ধরে আমার কাছে এসে বললেন, তুই আমার বউকে (আশা ভোসলেকে) ভয় পাচ্ছিস? এই আশাকে সৃষ্টি করেছি আমি, তুই আমার সামনে গাইতে পারলি অথচ আশাকে ভয় পাচ্ছিস? বললাম, পঞ্চমদা আমাকে ক্ষমা করো। আমি আশাজির সামনে গাইতে পারব না। তখন আশা ভোসলে হেসে আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি পুরো গানটা গাইলাম। এবার আমার গায়কি শুনে পঞ্চমদাও খুব খুশি। অল্প সময়ের মধ্যেই দুটি গান গেয়ে ফেললাম।