জীবনের গল্প ফুরাল তবে

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

‘যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও/ যা কিছু বলার যাও বলে যাও/ পাবে না সময় আর হয়তো।’ ঠিক। সময় পাওয়া যায় না। আর হয়ে ওঠে না বলা। শরীরে কর্কটের বসত ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসে জীবনে মূক সময়। তাই চলে যেতে হয় ‘জীবনের গল্প’ বাকি রেখেই।

সেই শৈশব-কৈশোর। শত চ্যানেলের বাহাদুরিহীন সেই সুচারু শ্রবণ ও দর্শনের দিন। বিকেল পাঁচটার আগে বোকাবাক্স খুলবে না। খুললেই–বা কী? বাইরে ডাকবে তখন খেলার সাথিরা। কিন্তু এই স্থির ও অশেষ কল্পনার দুপুরটুকু কী করে পার হওয়া যায়? এ যেন সাগর। এ যেন তিরহীন এক অথই। মায়েরা তখন অবধারিতভাবেই অবেলায় ডেকে আনতে চাইত ঘুম। কিন্তু ঘুম তো চুরি করে নেয় সুরের অবসর। সুর। হ্যাঁ, সুর, যা বেজে উঠবে প্রিয় লাল টুইনওয়ানের ভেতর থেকে, যা ভেসে আসবে কোনো এক সুদূর থেকে।

বেলা একটা। বাংলাদেশ বেতারের একঘেয়ে সংবাদের পর শুরু হতো বিজ্ঞাপন বিরতি। কোনো দিন ‘গিতালী’, কোনো দিন ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’। ছিল ‘বেবি লজেন্স সংগীতমালা’ কিংবা এ রকম ‘জনি প্রিন্ট শাড়ি’সহ নানা পণ্যের স্পনসরে গানের অনুষ্ঠান। আর এসব সংগীত অনুষ্ঠানে অবধারিতভাবে যে কণ্ঠটি ভেসে আসত প্রিয় সুর নিয়ে, তা এন্ড্রু কিশোরের। না, কোনো অনুরোধের আসরেই গানের অনুরোধ করে চিঠি বা পোস্টকার্ড পাঠানো হয়নি। কিন্তু নিশ্চিত থাকা যেত এই ভেবে যে সুদূর হাতিয়া কিংবা ঢাকার উত্তরা থেকে কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে যেকেউ বা অনেকেই তাঁর গান শুনতে চাইবেন। তা-ই হতো। বারবার বরাবর। আর তিন ব্যান্ডের রেডিও কিংবা সেই লাল টুইনওয়ানের বরাতে বারবার গেয়ে চলতেন এন্ড্রু কিশোর ক্লান্তিহীনভাবে, তলহীন বৈচিত্র্যে।

কণ্ঠের প্রেমে মজে যাওয়ার বহু পরে কণ্ঠের মালিককে আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। তার আগেই তিনি ‘বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে’, সেখানে স্থান করে নিয়েছিলেন। আনন্দ-বেদনার সুরের গলিঘুপচি ধরে ধীরপায়ে হেঁটে তিনি এসে সেই স্থান দখল করেছিলেন। হঠাৎ করে কোনো একটি গান দিয়ে রাতারাতি ক্ষণিকের তারা হননি তিনি।

সেই যে ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গাইলেন; রেডিওর এপাশ থেকে শুনেই বুকে কেমন ব্যথা জমে উঠল। মনে হলো, ‘কী বলে লোকটা?’ কেন ডাকবে তাঁকে দয়াল? কেন তিনি আমাদের মাঝে আর বেশি দিন থাকতে পারবেন না? গানের কথাটিই এমন হু হু করা বোধ জন্ম দিয়েছিল। অথচ এই এখন, এই ‘বেবি লজেন্স সংগীতমালা’হীন এই সময়ে এটাই তো সত্য হয়ে এল।

না, কোনো এলিজি নয়। যাঁর কণ্ঠ চিরতরুণ, তাঁর চলে যাওয়ায় বিদায় বলতে মানা। শৈশব-কৈশোর রাঙানো লোকেরা বরাবরই জাদুকরের মহিমাপ্রাপ্ত। আর জাদুকরেরা ভেলকি দেখায়। কে না জানে, যেকোনো জাদুকরের শেষ ভেলকিটি তোলা থাকে নিজের জন্যই। কোনো ফুটো পয়সার হাতসাফাই নয়, কোনো বুক ধুকপুক করা ম্যাজিক নয়। দক্ষ জাদুকর তো সেই, যে বিমূঢ় দর্শকদের রেখে যান বিস্ময়ের ঘেরাটোপে, যখন তাঁর প্রস্থানের সত্যটাও অনুধাবনে কষ্ট হয়। এন্ড্রু কিশোর তাই করেছেন।

তিনি চলে যাবেন, এটা একরকম নিশ্চিতই ছিল। তবু ভালোবাসার রীতি মেনেই আশা থাকে। কিন্তু হলো না। তিনি চলে গেলেন। সেই রেডিও যুগ, বিটিভির সেই ‘ছায়াছন্দ’ যুগ, সেই সব স্যাঁতস্যাঁতে চুল কাটার দিনের সেলুন, সেই সব গল্প বুড়োর আঁজলা থেকে চুইয়ে পড়া গানের কলি—সব এক লহমায় সামনে চলে আসছে। তারা আজ আরেক অনুরোধের আসর বসাতে চাইছে, যেখানে শুধু বাজবে আপনারই গান।

সবাই ভালোবাসা চায়—এ সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য এই ভালোবাসা ‘কেউ পায়, কেউবা হারায়’। প্রিয় অ্যান্ড্রু কিশোর আপনি পাওয়াদের দলে। এ দেশের কোটি মানুষের হৃদয়ের মধ্যিখানে আপনার বাস। তারা আরও অসংখ্য দিন পার করে দেবে নিজ নিজ ব্যক্তিগত অনুরোধের আসরে আপনাকে ডেকে এনে নিজের কণ্ঠে, নিজের যন্ত্রে, নিজের ভাবনায়।