এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকার লড়াই

দুই সন্তানকে নিয়ে এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর স্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত
দুই সন্তানকে নিয়ে এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর স্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত

এন্ড্রু কিশোরের স্ত্রী লিপিকাকে শ্রুতলেখকের কাজ করতে হতো। হাসপাতালের বিছানা থেকে এন্ড্রু কিশোর ফেসবুকে ভক্তদের কিছু বলবেন, সেটা লিখে দিতেন লিপিকা। তবে গত রোববার স্বামীর ফ্যান পেজে লিখতে হয়েছে তাঁর নিজের কথা। সেখানে স্বামীকে নিয়ে নিজের লড়াইয়ের শেষ অংশটুকু তুলে ধরেন লিপিকা।

গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যান লিপিকা। পরীক্ষায় ধরা পড়ে তাঁর অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডে ক্যানসার! শুরু হয় কেমো ও রেডিও থেরাপি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে থেরাপি শেষে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, আপাতত কোনো কেমোর আর দরকার নেই। এখন থেকে শুধু ওষুধ খেতে হবে। চাইলে দেশেও ফিরতে পারেন তাঁরা। দেশে ফেরার টিকিট কেনা হলো। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর ভীষণ দুর্বল বোধ করছিলেন। টিকিট বাতিল করা হলো। চিকিৎসক জানালেন, এই দুর্বলতা কেমোর ধকল। ধীরে ধীরে সেরে উঠবেন তিনি। আবার ফেরার টিকিট করা হলো।

হঠাৎ জ্বর আসে এন্ড্রু কিশোরের। পরদিন রাতে সেই জ্বর আরও তীব্র হয়। আবার হাসপাতাল। কিন্তু কোনো ওষুধই আর কাজ করছিল না। ডাক্তাররা পিইটি স্ক্যান করাবেন, ভাইরাসগুলো আবার জীবন ফিরে পেল কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। স্বামীর এ অবস্থা কোনো স্ত্রীর পক্ষে সহ্য করা কঠিন। লিপিকা সে কথা লিখেছেন ফেসবুকে। ‘খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি ফিরে আসে, তখন তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ শক্তিশালী। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।’

প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর স্ত্রী । ছবি: সংগৃহীত
প্রথম আলোর এক অনুষ্ঠানে এন্ড্রু কিশোর ও তাঁর স্ত্রী । ছবি: সংগৃহীত

পিইটি স্ক্যান হলো। ফোনে ডাক্তার দেখা করতে বললেন লিপিকাকে। সে রাত আর ঘুমাতে পারলেন না তিনি। জীবনের ভয়ংকরতম রাতটি পার করে সকাল ১০টার মধ্যে পৌঁছে যান হাসপাতালে। স্বামীর পাশে গিয়ে বসলে তিনি বলেছিলেন, ‘ডাক্তারকে বলবা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরব।’ কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে লিপিকাকে নিয়ে যান ডাক্তার লিমের কাছে। তিনি বললেন, ‘লিম্ফোমা ফিরে এসেছে।’

ডাক্তার তাঁকে নিয়ে গেলেন মনিটরের সামনে। দেখালেন অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডে কিছু নেই, কিন্তু লিম্ফোমা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে ডান পাশের লিভার ও স্পাইনালে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছিল অল্প অল্প। চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন লিপিকা। ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এবার?’ ডাক্তার বললেন, ‘আর কিছুই করার নেই।’ লিপিকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘...আর কত দিন?’ তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘ইটস ডিফিকাল্ট টু প্রেডিক্ট বাট টিপিক্যালি ইন টার্মস অব মানথ র‍্যাদার দেন ইয়ার্স।’ লিপিকা লিখেছেন, ‘আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ থেকে অঝোরে জল ঝরছিল। নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কিশোর বুঝতে পেরেছিল। সে আমাকে ডাকছিল।’

নিজের নিশ্চিত মৃত্যুর কথা স্বামীকে জানানোর মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পাড়ি দিতে পেরেছেন লিপিকা। ক্যানসারের সঙ্গে এন্ড্রু কিশোরের লড়াইটা তাঁর একার ছিল না। স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রুও শামিল হয়েছিলেন সেই লড়াইয়ে। লড়তে লড়তে শিল্পী চলে গেছেন। লড়াইয়ের দুঃসহ বেদনা একা বুকে বয়ে বেড়াবেন লিপিকা এন্ড্রু। হয়তো স্বামীর কণ্ঠ কানে বাজবে, ‘এই না ভুবন ছাড়তে হবে দুই দিন আগে–পরে।’