বিদায় এন্ড্রু কিশোর, আমাদের মেলোডি কিং

এন্ড্রু কিশোর। ফাইল ছবি
এন্ড্রু কিশোর। ফাইল ছবি

১৯৮০ সালের শেষের দিকে এবং নব্বইয়ের দশকে আমরা যাঁরা বড় হয়েছি, তাঁদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে বেতারের জনপ্রিয়তার যুগ। তখন নাম ছিল রেডিও বাংলাদেশ। মধ্যদুপুরে বিভিন্ন ব্যান্ডের গ্রাহক যন্ত্রে ধরা পড়ত মহাজাগতিক তরঙ্গমালা। বিজ্ঞাপন তরঙ্গে সেখানে ভেসে আসত মজহারুল ইসলামের কণ্ঠ। আমরা শুনতাম ‘হ্যাঁ ভাই, আছে মেলোডি কিং এন্ড্রু কিশোর।’ তারপর শোনা যেত, মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রটিতে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানের দুটি লাইন।

আমাদের কৈশোর, তারুণ্য, যৌবনের দিনে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন আমাদের কণ্ঠে, রোমান্টিক মেলোডি গানগুলোর জন্য। রোমান্টিক মেলোডি গান বাংলাদেশের আরও অনেক পুরুষ শিল্পীই গেয়েছেন। প্রচুর জনপ্রিয় গানও আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া। কিন্তু মজহারুল ইসলাম কেন শুধু তাঁকেই মেলোডি কিং আখ্যা দিয়েছিলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারব না। কিন্তু সে বিশেষণ মনে হয় না ভুল ছিল।

ভুল ছিল না এই কারণে বলছি যে, সে সময়ের কোনো কোনো চলচ্চিত্রের নাম স্মরণ করতে না পারলেও অনেকে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া গানের কথা মনে রেখেছেন এখনো। যখন আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ছাড়িয়ে আরও বড় ক্লাসে পড়ার বয়স, তখন পাড়ায়-মহল্লায় প্রচুর ‘বড় ভাই’ এন্ড্রু বিশোরের গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। তবে তাঁরাই সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন যাঁদের কণ্ঠ ও গায়কি ছিল এন্ড্রু কিশোরের একেবারে কাছাকাছি। নব্বইয়ের দশকে তাঁর গান গেয়ে কত স্থানীয় শিল্পী যে খ্যাতিমান হয়েছিলেন, তার কোনো হিসাব নেই।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে একটি গানের জন্য এন্ড্রু কিশোরের একার কৃতিত্ব নেই। গীতিকার, সুরকার কিংবা চলচ্চিত্রটির পরিচালকও সমান কৃতিত্বের অধিকারী। সবার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া জনপ্রিয়তম গানগুলো ‍দিন শেষে কীভাবে যেন এন্ড্রু কিশোরের হয়ে গেছে। মানুষ সেভাবেই মনে রেখেছে।

সংগীত, ফ্যাশন এগুলো বিস্তারের জন্য চলচ্চিত্রশিল্পের ভূমিকা ব্যাপক। এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্র মাধ্যমকেই বেছে নিয়েছিলেন নিজের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে। সেখানে সফল ছিলেন তিনি। হয়তো সফলতমও। নব্বইয়ের দশকে যখন একক অ্যালবামের জনপ্রিয়তার যুগ, তখনো তাঁর একক অ্যালবাম ছিল হাতে গোনা। তিনি বরং তখন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন কিংবা কনকচাঁপা অথবা বেবী নাজনীন কিংবা আরও অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে চলচ্চিত্রের গানের জন্য জুটি বেঁধে একের পর এক ‘হিট’ এবং ‘সুপার–ডুপার হিট’ গান উপহার দিয়েছেন আমাদের। একক শিল্পী হিসেবে সংখ্যার বিচারে এত জনপ্রিয় গান কি বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে আর আছে? এটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা দরকার। নইলে এন্ড্রু কিশোরের প্রতি অবিচার করা হবে।

এন্ড্রু কিশোর। ফাইল ছবি
এন্ড্রু কিশোর। ফাইল ছবি

‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তুই যে আমার মিলনমালা রে বন্ধু’, ‘ডুব দিয়ো না জলে কন্যা’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে’—কোন গান ছেড়ে কোন গান শুনব আমরা?

শোনা যায়, মোহাম্মদ রফি কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে নায়কের জন্য গান গাইতেন গানের দমে তাঁরাই হিন্দি কিংবা টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রপাড়ায় হিট হয়ে যেতেন। আমাদের চলচ্চিত্রপাড়ায় সে রকম কোনো ঘটনা আমরা এখনো শুনিনি। কিন্তু ৮০-৯০–এর দশকে এন্ড্রু কিশোর যখন গান গাইছেন, তখন চলচ্চিত্র পরিচালকেরা কেন বারবার তাঁর কাছে ফিরে যাচ্ছেন, সেটি কিন্তু বড় প্রশ্ন। নায়করাজ রাজ্জাক থেকে শুরু করে ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, মান্না, সালমান শাহ, ওমর সানী, রিয়াজ—সবাই ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তাঁর গানে। যেকোনো নায়কের প্রেম-অভিমান-দুঃখের গানের জন্য নির্ভরযোগ্য ছিলেন এন্ড্রু কিশোর, সেটা বলা যায় চলচ্চিত্রে তাঁর জনপ্রিয় গানের সংখ্যা দেখে।

শুধু একক গানই নয়। দ্বৈত কণ্ঠে কিংবা ত্রয়ী কণ্ঠের যুগলবন্দীতেও বলা চলে ইতিহাস গড়েছেন এন্ড্রু কিশোর। ছোট্ট একটি দৃশ্যের কথা বলা যাক। চলচ্চিত্রের নাম ‘শেষ খেলা’। এই চলচ্চিত্রটিতে একটি অসাধারণ গান আছে ‘সুন্দর সন্ধ্যায় কী গান দেব উপহার’ শিরোনামে রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী এবং এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে। নিবিষ্ট শ্রোতা না হলে আব্দুল হাদী এবং এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠ পৃথক করা যায় না এ গানে। একটু চড়া কণ্ঠে গেয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। তারপরেই কোমল পুরুষ কণ্ঠটি এন্ড্রু কিশোরের। নায়ক মান্না ঠোঁট মিলিয়েছিলেন তাতে। আর খলনায়ক রাজীব ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে। চম্পা ঠোঁট মিলিয়েছিলেন রুনা লায়লার কণ্ঠে। রুনা লায়লা-আব্দুল হাদী-এন্ড্রু কিশোরের এই অসাধারণ যুগলবন্দী বাংলা গানের জগতে বিরল।

সব পাখি নীড়ে ফেরে সূর্য অস্ত গেলে। প্রকৃতির এই নিয়ম, শাশ্বত নিয়ম। তবু কোনো কোনো ফেরায় রেশ থেকে যায়। থেকে যায় শূন্যতা। মেলোডি কিংয়ের নীড়ে ফেরায় রেশ এবং শূন্যতা দুটোই থেকে যাবে।

বিদায় এন্ড্রু কিশোর, আমাদের মেলোডি কিং।
‘…কভু যদি পাখির গান থেমে যায়, আকাশ কি দেবে বিদায়…’