'মহানায়কের' মৃত্যুদিন চলে গেল নীরবে

বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

তিনি ছিলেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক'। ‘দেবদাস’–খ্যাত বুলবুল আহমেদ ভক্তদের ভালোবাসায় হয়ে উঠেছিলেন মহানায়ক কিংবা বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতুল্য এক অভিনেতা। ১৫ জুলাই ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। নীরবেই কেটে গেল মহানায়কের প্রয়াণ দিবস। ২০১০ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন তিনি।

শৈশবে ব্যাডমিন্টন ছিল বুলবুল আহমেদের পছন্দ। সেই সঙ্গে ক্রিকেট। সাইকেল নিয়ে চক্কর দিতেন পুরান ঢাকার আনাচকানাচে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সময় কাটত তাঁর। হঠাৎ সেই আড্ডাপ্রাণ কিশোরকে পেয়ে বসে অভিনয়। নাটকের মহড়া দেখার আগ্রহ বুলবুল আহমেদের। ছেলের আগ্রহ বুঝতে পারতেন বাবা, কিন্তু তিনি চাইতেন, ছেলে যেন এই পথে না আসে। বুলবুল আহমেদের বাবা নাটকে অভিনয় করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন। পরে এই অভিনেতা লুকিয়ে দেখতেন বাবার নাটকের অনুশীলন। এভাবেই বাংলা চলচ্চিত্রের এই মহানায়কের ভালোবাসা জন্মে অভিনয়ের প্রতি।

এমন করেই কাটছে শৈশব ও কৈশোর। একটা সময় ঢাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে শ্যামলী শিল্পী সংঘ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করেন। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে এই সংঘের যাত্রা শুরু হয়। সংঘের একটি নাটকে বুলবুল আহমেদের অভিনয় দেখে তাঁর বাবা বুঝতে পেরেছিলেন, অভিনয়ই ছেলের পছন্দ, যদিও বাবা চাইতেন ছেলে হোক ব্যারিস্টার।

বাবার ইচ্ছাকে কল্পনায় রেখে দিয়ে একসময় ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকে পড়েন বুলবুল আহমেদ। পাশাপাশি চলে অভিনয়। পেশাগতভাবে ব্যাংকার হিসেবেও ছিলেন অসাধারণ। কিন্তু শিল্পের প্রতি যাঁর প্রবল টান, তাঁকে কী করে টাকার হিসাব–নিকাশে আটকে রাখা যায়! ভাবছেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে অনিশ্চয়তায় ভরা অভিনয় পেশাকে বেছে নেবেন? বুঝতে পারছিলেন না।

বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

তখনকার পরিস্থিতি এভাবেই স্মরণ করলেন তাঁর স্ত্রী ডেইজী আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি বলতাম, ব্যাংকার হিসেবেই অল্প সময়ে অনেক নাম করেছ। এটা ছাড়া ঠিক হবে না। তিনি বলতেন, অভিনয় ছাড়া ভালো লাগে না। তখন তিনি “ইয়ে করে বিয়ে” নামে মাত্র একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। একটু পরিচিতি হচ্ছে। বাইরে গেলে কিছু মানুষ তাঁকে চেনে। হঠাৎ একদিন বললেন, চাকরি ছেড়েই দেবেন। তখন আমি ভয় পাচ্ছিলাম। একটা নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে ঝুঁকির পথে পা বাড়াতে নিষেধ করি তাঁকে।’

কিন্তু স্ত্রীর কথা শুনে দমে যাননি বুলবুল আহমেদ। স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য শাশুড়ির দ্বারস্থ হন। শাশুড়িকে অনুরোধ করেন, তাঁর মেয়েকে বোঝাতে। তাঁর স্ত্রী ডেইজী আহমেদ বলেন, ‘তখন আম্মা আবার আমাকে এসে বোঝাতেন, “ও তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করে, তুমি কেন ওর স্বপ্ন পূরণ করতে বাধা দিচ্ছ?” তখন আমি বাধ্য হয়ে তাঁর অভিনয় করার বিষয়ে রাজি হই। কিন্তু বারবারই তাঁকে বলতাম, জীবন নিয়ে তুমি জুয়া খেলছ।’

ছোট মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদের সঙ্গে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
ছোট মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদের সঙ্গে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

স্ত্রীর অনুমতির পরই পুরোদস্তুর অভিনয়ে নেমে পড়েন বুলবুল আহমেদ। এমন করে চলতে থাকে। কিন্তু সাফল্য যেন ধরা দেয় না। ক্যারিয়ার নিয়ে দোটানায় পরে যান তিনি। স্ত্রী এবার পাশে দাঁড়ান। মনোবল না ভেঙে স্বামীকে অভিনয় করে যেতে বলেন। ১৯৭৭ সাল। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিতে অভিনয় করার পর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। একে একে ‘বধু বিদায়’, ‘রুপালী সৈকত’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দেবদাস’ ছবিগুলো দিয়ে নিজের জায়গা পাকা করেন বুলবুল আহমেদ। বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। এমন সময় চুক্তিবদ্ধ হন ‘জীবন নিয়ে জুয়া’ নামের ছবিতে। সেই ছবি সুপারহিট হয় বক্স অফিসে। ক্রমেই যেন টাকা আয়ের মেশিনে পরিণত হতে শুরু করেন বুলবুল আহমেদ।

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বড় তারকা হয়েও সাধারণ জীবন যাপন করতেন এই অভিনেতা। তাঁকে সব সময় সাধারণ বেশেই দেখেছেন তাঁর সন্তানেরা। বুলবুল আহমেদ বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর মেয়ে অগ্নিলাকে দিয়ে যেন সে ইচ্ছা পূরণ করিয়েছেন। অগ্নিলাকে বানিয়েছেন আইনজীবী। তাঁর বড় মেয়ে তাহসিন ফারজানা তিলোত্তমা বাবার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বাবা আমাদের প্রচুর সময় দিতেন। বাবা তখন অনেক বড় তারকা। তারপরও বাবা আমাদের স্কুলে দিয়ে আসতেন। রাস্তায় যত মানুষের সঙ্গে দেখা হতো, তিনি হাত নেড়ে কথা বলতেন। কখনো তাঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। অহংকার তাঁর মধ্যে আশ্রয় পায়নি। অভিনয়ে ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও বাবা আমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন।’

কাজের ব্যাপারে সব সময়ই সিরিয়াস ছিলেন বুলবুল আহমেদ। তবু পরিবার ও সহকর্মী সবাইকে সময় দিতেন। তাঁকে নিয়ে পরিচালকদের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। তবু কাউকে না করতে পারতেন না। এমনকি বাধ্য হয়ে নির্মাতাদের মন রক্ষা করতে তিনটি সেটে একই দিনে শুটিং করতে হয়েছে তাঁকে।

তবে ব্যস্ত এই তারকার শেষ জীবনটা খুব ভালো কাটেনি। বৃদ্ধ বয়সে অপেক্ষা করতেন কোনো ভালো চরিত্রের জন্য। কিন্তু ওই ভালো মানের চরিত্র নিয়ে কেউ তাঁর কাছে আসেনি। তাই শেষ বয়সে একটা আক্ষেপই থেকে গেল এই অভিনেতার। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মানুষগুলো সুখের পায়রা। যখন শুটিং করতেন, তখন সবাই দলবলে আসতেন। আড্ডা দিতেন, খাওয়াদাওয়া করতেন। একবার দেখা করার জন্য সারা দিন বসে থাকতেন। শিডিউলের জন্য আমাকে ধরতেন। কিন্তু তাঁর একাকী সময়ে কেউ কোনো দিন তাঁকে দেখতে আসেনি। সেই কষ্ট বুকে নিয়েই তিনি মারা গেছেন।’

একটি নাটকের দৃশ্যে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
একটি নাটকের দৃশ্যে বুলবুল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বুলবুল আহমেদের এই আফসোসের কথা জানতেন তাঁর সন্তানেরাও। মেয়ে তাহসিন ফারজানা তিলোত্তমা বলেন, ‘বাবার শেষ জীবন নিয়ে আমাদের মনে খুবই কষ্ট আছে। ওই সময় পরিচিত দু-একজন যাঁরা আসতেন, তাঁদের দেখে বাবা একদম সুস্থ হয়ে যেতেন। খুবই খুশি হতেন। বোঝা যেত না বাবা অসুস্থ। পরিচিত মানুষেরা খবর নিলে হয়তো বাবা আরও কিছুদিন বাঁচতেন।’

সেই কষ্ট থেকেই বুলবুল আহমেদের পরিবার থেকে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বুলবুল আহমেদ ফাউন্ডেশন’। যেসব অভিনয়শিল্পী একসময় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো এবং সহায়তা করা হয় এই ফাউন্ডেশন থেকে। এখান থেকে দেওয়া হয় ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা’। এ বছর এই পদক দেওয়া হয়েছে প্রবীণ অভিনেত্রী মীরানা জামানকে।

এ বছর মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা দেওয়া হয় অভিনেত্রী মীরানা জামানকে। ছবি: সংগৃহীত
এ বছর মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা দেওয়া হয় অভিনেত্রী মীরানা জামানকে। ছবি: সংগৃহীত

বুলবুল আহমেদ ১৯৭৬ সালে আলমগীর কবির পরিচালিত ‘সূর্যকন্যা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জহির রায়হান পুরস্কার লাভ করেন। অভিনয়ের জন্য তিনি চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’, ১৯৭৮ সালে ‘বধূ বিদায়’, ১৯৮০ সালে ‘শেষ উত্তর’ ও ১৯৮৭ সালে ‘রাজলক্ষ্মী–শ্রীকান্ত’ ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ছোট মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদের লেখা ‘একজন মহানায়কের কথা’ বই থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বুলবুল আহমেদের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো ‘রুপালি সৈকতে’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘মোহন’, ‘মহানায়ক’, ‘পুরস্কার’, ‘সোহাগ’, ‘বৌরানী’, ‘ঘর সংসার’, ‘বধূ বিদায়’, ‘ছোট মা’, ‘আরাধনা’, ‘সঙ্গিনী’, ‘সময় কথা বলে’, ‘স্মৃতি তুমি বেদনা’, ‘শেষ উত্তর’, ‘স্বামী’, ‘ওয়াদা’, ‘গাঙচিল’, ‘কলমিলতা’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দেবদাস’, ‘ভালো মানুষ’, ‘বদনাম’, ‘দুই জীবন’, ‘দিপু নাম্বার টু’, ‘ফেরারি বসন্ত’, ‘দ্য ফাদার’, ‘রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত’।