সংকট কাটিয়ে এগিয়ে যেতে চান থিয়েটারকর্মীরা

প্রাঙ্গণেমোরের উদ্যোগে পাঁচটি ভ্যানে করে সবজি বিক্রির আয়োজন করা হয়। টিকে থাকার লড়াইয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন থিয়েটারকর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত
প্রাঙ্গণেমোরের উদ্যোগে পাঁচটি ভ্যানে করে সবজি বিক্রির আয়োজন করা হয়। টিকে থাকার লড়াইয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন থিয়েটারকর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

তরুণ থিয়েটারকর্মীরা জীবন চালাতে কেউ করতেন টিউশনি, কেউ জড়িত ছিলেন ডাবিং শিল্পে, কেউ কাজ করতেন টিভিতে। করোনায় বন্ধ আয়ের উৎস। আবার নাটকের দলগুলো মহড়াকক্ষের খরচ, সেট, প্রপস ও সংশ্লিষ্ট দ্রব্যসামগ্রী সুরক্ষায় অর্থ ব্যয়ে পড়ছে সংকটে। এ সংকটকাল কাটাতে থিয়েটারকর্মী ও দলগুলো নিয়েছে নানা উদ্যোগ। তবে এ সংকটে থেমে নেই থিয়েটারকর্মীরা। অনলাইনে ও বিকল্পভাবে নানা প্রক্রিয়ায় থিয়েটারকর্মীরা চেষ্টা করছেন সক্রিয় থাকতে।

জীবিকার তাগিদে কাজের বিকল্প ব্যবস্থাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ করছেন অনলাইনে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার সেবা, কেউ চেষ্টা করছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তুলতে। সম্প্রতি প্রাঙ্গণেমোরের পাঁচটি থিয়েটার ভ্যানের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রির বিষয়টি উঠে এসেছে আলোচনায়। দলের পরিচালক (সাংগঠনিক) নূনা আফরোজ বলেন, ‘থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা জীবন চালাতে এমন কিছু কাজ বেছে নেয়, যেগুলোর সঙ্গে থিয়েটারের সংঘাত হয় না। এখন এই কাজ বন্ধ। অনেক কর্মী গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এমন একটা কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার, যা করতে অল্প মূলধন লাগে, অল্প সময়ে কাজটি করা যায়, আবার কাজটি করার মাধ্যমে এই সংকটকালও পেরোনো যায়। সেখান থেকেই এ উদ্যোগ।’

নাট্যজন মামুনুর রশীদ এ উদ্যোগকে দেখছেন ইতিবাচকভাবে। তিনি বলেন, ‘শিল্পীদের সবজির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে, এটা একটা প্রতিবাদ। আরেকটা দিক হচ্ছে চোখ খুলে দেওয়া যে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা কায়িক শ্রম করেই থিয়েটার করি। আমরা এটাও করতে পারি। কাজেই এটাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি।’

এই নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা এ প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দিলেন শিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্রান্টের। তিনি বলেন, ‘ওরা ইঙ্গিত দিল যে নাট্যশিল্পীদের পক্ষে রাষ্ট্র সেভাবে দাঁড়াল না। আমি অনেক বছর ধরেই চেষ্টা করছি সরকারি স্যালারি গ্রান্ট নিয়ে। তা হয়নি।’

বেশির ভাগই ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন, তবে কেউ কেউ মিশ্র প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে নূনা আফরোজ বলেন, ‘এ উদ্যোগ কেউ কেউ অন্যভাবে দেখছেন। কিন্তু এটা শুধু সবজি বিক্রি করা নয়, প্রতীকী প্রতিবাদও বটে। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় আছে। দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গেলে একই কাজ করে। কিন্তু আমাদের দেশে করতে পারে না। কারণ, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে কাজকে ছোট করে দেখা হয়। আমরা চেয়েছি, সেই আগলটাকে ভেঙে দিতে।’

বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছেন ‘বটতলা’ নাটকের দলের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী হায়দারও। অনলাইনে ইতিমধ্যে অনেক থিয়েটার দল ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে আছে শিল্পকর্ম বিক্রি, নিত্যপ্রয়োজনীয় টাটকা জিনিসের ব্যবসা ইত্যাদি। ফ্রাইডে থিয়েটার শপের নাম বলা যায়। পাশাপাশি থিয়েটারচর্চাকে সক্রিয় রাখারও চেষ্টা করছেন অনেকে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বন্ধ হয়েছে গত ১৮ মার্চ থেকে। কিন্তু মঞ্চের বাতি এখনো জ্বলেনি। তবে বিভিন্ন নাটকের অনলাইন প্রিমিয়ার, স্বল্প পরিসরে পথনাটকের চিন্তা, অনলাইনে থিয়েটার নিয়ে সেমিনার, অনলাইনে থিয়েটার কর্মশালাসহ নানা আয়োজন করে যাচ্ছেন থিয়েটারকর্মীরা। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার তাদের বেশ কটি প্রযোজনা অনলাইন প্রিমিয়ার করেছে। এ ছাড়া আজ রোববার প্রিমিয়ার হবে আপস্টেজ এর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’।

‘ড. হ্যানিম্যান’ চরিত্রে মীর জাহিদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত
‘ড. হ্যানিম্যান’ চরিত্রে মীর জাহিদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত

শুধু তাই নয়, অনলাইনে মহড়াও করছে নানা নাট্যদল। ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটকের নতুন নাটকের মাধ্যমে দীর্ঘ তিন দশক পর মঞ্চে দেখা যাবে অভিনেতা আফজাল হোসেনকে। মাসুম রেজার রচনায় ‘পেন্ডুলাম’ নামে নাটকটির নির্দেশনা দিচ্ছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। নাটকের দল অনুস্বার আনছে মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় আর্থার মিলারের ‘দ্য প্রাইস’ নাটকটি ‘মূল্য ও অমূল্য’ নামে। শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ঢাকা থিয়েটার আনছে আরেকটি নাটক আনন জামানের রচনায় ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় মীর জাহিদ হাসানের একক অভিনয়ে নিয়ে আসছে নাটক ‘ড. হ্যানিম্যান’। এ ছাড়া কোনো কোনো দল অনলাইনে থিয়েটারবিষয়ক আড্ডা, অনলাইনে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। নাটকের দল প্রাচ্যনাট ও বটতলা নিয়মিতই এ আয়োজন করছে।

থিয়েটারকর্মীদের টিকে থাকার বিষয়টিও এই সময়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসছে। নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘এগুলো ভালো উদ্যোগ। জীবন চালাতে হবে যে করেই হোক। সবাইকে নিজের পথটা আবিষ্কার করে নিতে হবে। কেউ কাউকে সাহায্য করে কত দিন চালাতে পারবে? সুতরাং প্রত্যেকেরই একটা বিকল্প ব্যবস্থা বের করতে হবে।’ এই নাট্যজনের কথা, এই সময়ে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং করপোরেট ব্যবসায়ীদের সাধারণ মানুষকে সহায়তা করা উচিত।

করোনাকালে মঞ্চের পাদপ্রদীপে আলো জ্বলছে না। জ্বলছে না মঞ্চকর্মীদের জীবনেও। কিন্তু তাঁরা দমে যাওয়ার পাত্র নন। জীবন চালিয়ে নিতে নিচ্ছেন নানা উদ্যোগ।