সময় থেকে আমরা যেন শিক্ষাটা নিই

মোশাররফ করিম। ছবি: প্রথম আলো
মোশাররফ করিম। ছবি: প্রথম আলো

রাত প্রায় একটা। চারপাশে সুনসান নীরবতা। এই লেখাটা শুরু করার কিছুক্ষণ আগেই আমার ছেলে রাইয়ানের সঙ্গে খেলছিলাম। এটা শুধু খেলা বা কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করে মজা করার চেষ্টা করি। কখনো আমাদের মান–অভিমান হয়। ছেলেকে চমকে দিই। সব মিলিয়ে সে এক দারুণ ব্যাপার। বাবাকে পেয়ে ছেলে খুশিতে আত্মহারা। ছেলেকে আগেও সময় দেওয়া হতো, কিন্তু কোথাও যেন একটা বাধা ছিল। সেটা সময়ের। শুটিং থেকে ফিরে পরের দিন কাজে ফেরার তাড়া অনুভব করতাম। করোনার এই চার মাস সেই তাড়া নেই। কোনো কিছুতে ধরাবাঁধা নেই। আমার তিন দশকের ক্যারিয়ারে ৪ মাসের বিরতি, এটা কি খুব বেশি সময়? অথচ কতটা বদলে গেলাম আমরা।

কত বছর ধরে যে এভাবে সময় কাটাই না, সেটার সঠিক হিসাব বলতে পারব না। অন্য বছরগুলোয় এই সময়ে শুটিং হাউসেই পড়ে থাকতাম, চলত মাসজুড়ে ঈদ নাটকের কাজ, ব্যস্ততা। এই সব ব্যস্ততা মনে আনন্দ দিত। এই ঈদেও সেই একই কাজের চাপ ছিল। চেয়েছিলাম নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় কাজ করব একটু বিরতি দিয়ে, সময় নিয়ে। কিন্তু শুটিংয়ে গিয়ে দেখি, আমার চিরচেনা কাজের ক্ষেত্রটার বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা সরাসরি মাঠে থেকে কাজ করি। একটি ইউনিটে বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে শুটিং সেটে এক হয়। এই যে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করা, মেকআপ রুমে নিজেকে একটু সময় দেওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এসব মন থেকে হয়ে উঠছিল না। একটি ইউনিটে সবাই মাস্ক পরে আছে, হাতে গ্লাভস, প্রোডাকশন বয় ছেলেটার হাতে স্যানিটাইজারের বোতল, একটি দৃশ্যে ধারণ শেষ করে অন্য একটি রুমে একা বসে থাকা, বদলে যাওয়া এই পরিবেশ আমার মনে ভীষণ প্রভাব ফেলছে। শুটিংয়ে গিয়ে মন ভালো থাকে না, আতঙ্ক বোধ করি। মানসিক চাপে বুক ভারী হয়ে থাকে। একটি দৃশ্য করে মানসিক প্রশান্তি পাচ্ছি না। যে কাজ আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আনন্দ দেয়, আমাকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, সেখানেই আমি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এমন বিভিন্ন কারণে আমি কাজ করতে পারছিলাম না। পরে বাধ্য হয়ে সব কাজ বাতিল করতে হয়েছে।

নিজের সমস্যাগুলো কাউকে বোঝানো যায় না। চরিত্রের প্রয়োজনে সাজসজ্জা, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শুটিং করা, সংলাপ বলা, সীমিত পরিসরে মুভমেন্ট করা, নতুন একটা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, সব মিলিয়ে নতুন স্বাভাবিকে কাজটাকে উপভোগ করতে পারছিলাম না। শুরুর দিকে কিছু কাজ মানসিক তৃপ্তি নিয়ে করেছি। কিন্তু কদিন পরই আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তায় হাঁপিয়ে উঠলাম। যেই আমি কাজহীন সময় ভাবতে পারতাম না, সেই আমি এখন কাজের শিডিউল দিয়েও কাজ করতে পারছি না। কিন্তু কেন? কাজের জায়গায় প্রতিটি মুহূর্তে দুশ্চিন্তা, সতর্ক থাকার একটা তাগিদ, এসব সামলে নিজের মূল দায়িত্বের দিকে মনোযোগ আসছে না। এটাই আমার উত্তর।

আমি বুঝতে পারছি না, যাঁদের জন্য কাজ করব, তাঁরা কতটা বিনোদনের জন্য প্রস্তুত। সব মানুষ কতটা ভালো আছেন? ব্যস্ততায় আগে সেভাবে ঈদ পালন করতে পারতাম না। কিন্তু উৎসবের একটা আমেজ ঠিকই থাকত। এবার সেই প্রাণবন্ত ঈদের আঁচ পাচ্ছি না। বরং ঈদ আসায় আরও বেশি চিন্তা। আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য অনেক জায়গায় অনেক লোকসমাগম হবে। তখন সবাইকে ব্যাপক সতর্কতা থাকতে হবে। শুধু ঈদ না, এই সতর্কতা সামনের প্রতিটি দিনে আমাদের মেনে চলতে হবে। সমগ্র জীবনের জন্য অনেক কিছু করোনা আমাদের শিখিয়ে গেল। সময় থেকে আমরা যেন শিক্ষাটা নিই।