আজম, লাকী ও বুলবুলদের 'প্রতিবেশী' আলাউদ্দীন আলী

আজম, লাকী ও বুলবুলদের প্রতিবেশী আলাউদ্দীন আলী। ছবি-সংগৃহীত
আজম, লাকী ও বুলবুলদের প্রতিবেশী আলাউদ্দীন আলী। ছবি-সংগৃহীত

সংগীতের কয়েক দশকের পথচলায় একসঙ্গে তাঁদের অনেক স্মৃতি। একসঙ্গে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী অনেক গান। আলাউদ্দীন আলীকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের যেখানে সমাহিত করা হয়েছে, পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সংগীতের আরও তিন কিংবদন্তিতুল্য আজম খান, লাকী আখান্দ্‌ ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মৃত্যুর পরও যেন তাঁরা একে অপরের প্রতিবেশী হয়েই রইলেন। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আজ বিকেল চারটায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। কবরস্থান থেকে বাসায় ফেরার পথে সমাহিত করার বিষয়টি প্রথম আলোকে জানান আলাউদ্দীন আলীর মেয়ে আলিফ আলাউদ্দীনের স্বামী কাজী ফয়সাল আহমেদ।

আলাউদ্দীন আলীকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যান তাঁর শিষ্য সংগীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের বাবু। ফেরার পথে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘গুরু আমার তাঁর সঙ্গীদের পাশেই আছেন। দীর্ঘ যাত্রায় যাঁরা তাঁর সঙ্গী ছিলেন, তাঁরাই এখন তাঁর প্রতিবেশী। ওপারে ভালো থাকুন গুরু।’

‘দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো পাশে’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’,‘যেভাবে বাঁচি বেঁচে তো আছি’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা’—চলচ্চিত্রের এমন অসংখ্য গানের সঙ্গে মিশে আছে সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলীর নাম। চলচ্চিত্রে যিনি এমন শত শত গান উপহার দিয়েছেন, সেই চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর এফডিসিতে এলেন তিনি, নিথর দেহে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে, শেষবিদায় দিতে ছুটে আসেন দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের অনেকে। আলাউদ্দীন আলীকে বিদায়ের এই দিনে কেউ কান্না লুকিয়েছেন, কেউ তা পারেননি।

মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় আলাউদ্দীন আলীকে। ছবি: ফেসবুক
মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় আলাউদ্দীন আলীকে। ছবি: ফেসবুক

এফডিসিতে আনার পর শিল্পীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনও শ্রদ্ধা জানায়। শিল্পীদের মধ্যে দেখা গেছে কনকচাঁপা, পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার, এস আই টুটুল, শওকত আলী ইমন, বাদশা বুলবুল, নাজির মাহমুদ, আহমেদ রিজভী, ওমর সানি, জাহিদ হাসান, ফরিদ আহমেদ, কিশোরসহ অনেককে। আরও ছিলেন প্রযোজক শাহ আলম কিরণ, সাদেক বাচ্চু, খোরশেদ আলম, শামসুল আলম, মনিরুল ইসলাম, লিটন হাশমি, আলিম উল্যাহ, রাশিদুল আলম, ইকবাল; পরিচালক মুশফিকুর রহমান, সালাহউদ্দিন লাভলু, শাহীন সুমন; নির্মাতা এস এ হক অলিক প্রমুখ।

এফডিসিতে আনার আগে ঢাকার বনশ্রী ও খিলগাঁওয়ে আলাউদ্দীন আলীর দুটি জানাজা হয়। এফডিসির জানাজার পরই মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় তাঁর কবর। গতকাল বিকেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

আলাউদ্দীন আলী ফুসফুসের প্রদাহ ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যায় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। প্রথমে ২০১৫ সালের ৩ জুলাই আলাউদ্দীন আলীকে ব্যাংককে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর ফুসফুসে একটি টিউমার রয়েছে। এরপর তাঁর অন্যান্য শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি ক্যানসারের চিকিৎসাও চলছিল। এর আগে বেশ কয়েক দফায় তাঁকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। বাংলাদেশ ও ব্যাংককে তাঁর চিকিৎসা হয়েছে। সাভারে সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড কেন্দ্রেও তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন দীর্ঘদিন।

আলাউদ্দীন আলী। ছবি-সংগৃহীত
আলাউদ্দীন আলী। ছবি-সংগৃহীত

আলাউদ্দীন আলী বাংলা গান, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য শ্রোতৃপ্রিয় গান তৈরি করেছেন। তিনি একই সঙ্গে সুরকার, সংগীত পরিচালক, বেহালাবাদক ও গীতিকার। গান লিখে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। গুণী এই মানুষের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মায়ের নাম জোহরা খাতুন।

দেড় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে চলে আসেন আলাউদ্দীন আলী। তিন ভাই ও দুই বোনের সঙ্গে সেই কলোনিতেই বড় হন এই গুণী শিল্পী। সংগীতে প্রথম হাতেখড়ি ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে। পরে ১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন। শুরুটা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সহযোগী হিসেবে, পরে প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে কাজ করেন দীর্ঘদিন।