টোকিওতে বাংলা নাটক
টোকিওর বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার নিয়মিত কোর্স শুরু হয়েছে ২০১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে। এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাচের মোট ১৯ জন ছাত্রছাত্রী সেখানে বাংলা ভাষা এবং বাংলার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করছেন। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তাহব্যাপী উৎসব চলার সময় ছাত্রছাত্রীদের সেখানে নানা রকম অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। বাংলা ভাষার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা এ বছর বাংলা খাবারের স্টল চালু করা ছাড়াও বাংলা নাটক মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রথম বর্ষের ছাত্ররা বাংলা খাবার রান্না করে স্টলে তা বিক্রির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রদের দেওয়া হয় বাংলা নাটক মঞ্চায়নের দায়িত্ব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর-এর মঞ্চ উপস্থাপনার সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছিলেন এবং কয়েক মাস ধরে চলা অনুশীলনের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমিথিউস হলে সেই নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীরা। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ছয়জন ছাত্রছাত্রী এবং অবশিষ্ট তিনজনের ওপর দায়িত্ব ছিল মঞ্চসজ্জা, আলোকবিন্যাস, শব্দ নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য বিষয় দেখাশোনা করার।
অমলের চরিত্রে অভিনয় করেছে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইয়ুতা নাকানোসে। পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে সংলাপ বলে যাওয়া এই জাপানি ছাত্রের অভিনয় দেখে মনেই হয়নি বাংলা ভাষায় তাঁর হাতেখড়ি মাত্র দেড় বছর আগে। একই রকমের অভিনয় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সুধার চরিত্রে রূপদানকারী মিকাকো ওমাতা, ঠাকুরদার ভূমিকায় কোওসাকু ইতো, মোড়লের ভূমিকায় শিহো ওনোজাওয়া, মাধব দত্তের চরিত্রে ইয়ুকা ওসাওয়া এবং কবিরাজের ভূমিকায় তাকুইয়া তোদো। মঞ্চাভিনেতাদের সংখ্যা মাত্র ছয়জন হওয়ায় কয়েকজনকে দুটি চরিত্রেও অভিনয় করতে হয়েছে।
ডাকঘর-এর কাহিনি বঙ্গভাষীদের অনেকের কাছেই পরিচিত। রাজার চিঠির অপেক্ষায় থাকা অসুস্থ বালক অমলকে ঘিরে আবর্তিত সেই কাহিনিতে রবীন্দ্রনাথ জটিল সামাজিক সম্পর্কের অনেক কিছু তুলে ধরেছেন। তবে কাহিনির মূলে থেকে গেছে শয্যাশায়ী সেই অসুস্থ বালক ও তার আরোগ্য লাভের বাসনা। রাজার চিঠি শেষ পর্যন্ত অমলের কাছে পৌঁছায়, তবে সে মৃত্যুর রূপ নিয়ে। নাকানোসে ইয়ুতা সেই অসুস্থ বালকের আকুতি তাঁর সুন্দর অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে চমৎকারভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। অমলের সঙ্গে পরিচয় হওয়া ফুল কুড়ানো বালিকা সুধার অভিনয়ও ছিল চোখে পড়ার মতো।
জাপানের এই বাংলা ভাষার ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য নিজেদের অজান্তেই নতুন যে এক মাইলফলক স্থাপন করেছেন তা হলো, বিদেশের মাটিতে বিদেশিদের অভিনয়ে প্রথম একটি বাংলা নাটকের সফল মঞ্চায়ন। আর সেই নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে হওয়ায় সেই মাইলফলক হয়ে উঠেছে অনেক বেশি অর্থবহ।
নাটক মঞ্চায়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শুভা দাশগুপ্ত চক্রবর্তী। তবে তিনি অসুস্থ হয়ে ছুটিতে চলে যাওয়ায় অনুশীলন শুরুর পর সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসেন রেডিও জাপানের বাংলা বিভাগের কর্মী অজন্তা গুপ্ত। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক সহযোগিতায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কিওকো নিওয়া।
বাংলা ভাষার জাপানি ছাত্রদের নাটক মঞ্চায়নে উপস্থিত ছিলেন জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। সারা বিশ্বে নতুন মাইলফলক গড়ে নেওয়া জাপানিদের বাংলা ভাষার অভিনয়-পারদর্শিতা তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখেন এবং নাটকের শেষে অভিনেতা ও অন্য সবাইকে তিনি অভিনন্দন জানান।