ধরুন, ভাগ্যের পরিহাসে একদিন একটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একা একটি প্রকোষ্ঠে আটকে আছেন আপনি। কথা বলার কেউ নেই, নেই তেমন খাবার, এমনকি পান করার পর্যাপ্ত পানিটুকু। চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো, চরম একাকিত্ব আর মৃত্যুর হাতছানির মাঝে এভাবে কয়টা দিন ওখানে টিকে থাকতে পারবেন আপনি? এমন পরিস্থিতি কতটা মানসিক বল প্রয়োজন? ঠিক এমনই একটি পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফিরে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদেরই বোন রেশমা। সাভারের ওই ধ্বংসস্তূপের হাজারো লাশের মিছিলে টানা ১৭ দিন সংগ্রাম করে সে বেঁচে ফিরেছে। ঘটনার বিবরণ শুনে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করা যায়, যা হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যেমনটি আমরা দেখেছি অস্কার বিজয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েল পরিচালিত ১২৭ আওয়ার্স (২০১০) ছবিতে। ছবিটির মূল চরিত্র ২৭ বছর বয়সী পরিব্রাজক অ্যারন রালস্টোনের লেখা স্মৃতিচারণা বিটুইন এ রক অ্যান্ড এ হার্ড প্লেস-এ বর্ণিত সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ১২৭ আওয়ার্স ছবিটি। মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন জেমস ফ্রাংকো। আর সংগীত পরিচালনায় ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জীবিত কিংবদন্তি এ আর রহমান। ছুটির দিনে অ্যারনের নেশা ছিল এক দিনের জন্য কাউকে গন্তব্য না বলে ইচ্ছামতো হারিয়ে যাওয়া। এটাই ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। ২০০৩ সালের ২৬ এপ্রিল শনিবার ঘুরতে ঘুরতে সে ক্যানিয়নল্যান্ডের ব্লু জন ক্যানিয়ন বেয়ে নামতে গিয়ে পাথর ফসকে এক ফাটলের মাঝে পড়ে যায় এবং তার ডান হাত আটকে যায়। অনেক চেষ্টা করেও সেই পাথরখণ্ড নাড়ানো সম্ভব না হলে সে চিৎকার করে সাহায্য প্রার্থনা করে। সেই চিৎকার পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, কিন্তু আর কেউ শুনতে পায় না। বাঁচার চরম আকুতি নিয়ে ব্যাগে যা কিছু ছিল, তা-ই নিয়ে সে চেষ্টা করতে শুরু করে। ছোট চাকু দিয়ে পাথর কাটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। খাবার বলতে সঙ্গে ছিল একটি বোতলে পানি আর দু-তিনটি শুকনো রুটি। এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার চেষ্টা করে সে। রাতে চরম ঠান্ডা আর দিনে গরমের মাঝে চলে টিকে থাকার সংগ্রাম। প্রতিদিন সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দাঁড়কাক তার ওপর দিয়ে ডেকে ডেকে উড়ে যেত। জীবিত সঙ্গী বলতে এটি আর কিছু পোকামাকড় বাদে আর কেউ ছিল না। এ অবস্থায় নিজেকে ধরে রাখতে ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করে, কখনো নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে আবার কখনো সুখের স্মৃতি মনে করে সে কাটাতে লাগল প্রতিটি দিন এবং রাত। একসময় মনে আফসোস হয় এই ভেবে যে, সে কেন তার গন্তব্য কাউকে জানিয়ে আসেনি। তাহলে হয়তো কেউ খুঁজতে আসত। এই পরিস্থিতিকে কিছুটা ভাগ্য এবং বাকিটা নিজের দোষ হিসেবেই সে মেনে নেয়। সে উপলব্ধি করে, এই পাথরখণ্ড যেন কোটি বছর ধরে শুধু তার জন্যই অপেক্ষায় ছিল যে সে আসবে এবং তাকে এখানে আটকে রাখবে। এটাই যেন তার পরিণতি। খুব মনে পড়ে বাবা-মা, বোন, প্রিয়তমা র্যানার কথা। মনে পড়ে সদ্যপরিচিত হওয়া কৃষ্টি ও মেগানের কথা এবং তাদের পার্টির দাওয়াতের কথা। ওদিকে ডান হাত ধূসর-নীল বর্ণ ধারণ করেছে। খাবার ও পানি শেষ পর্যায়ে। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। ইস্! বৃষ্টির পানির তোড়ে যদি সে পাথরসহ ভেসে যেতে পারত! একপর্যায়ে পানির অভাব পূরণে নিজের প্রস্রাব খেতেও সে বাধ্য হয়। যখন বাঁচার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ সে স্বপ্ন দেখে ফুটফুটে সুন্দর একটি ছেলে হবে তার। ছেলের কথা ভেবে বাঁচার শেষ চেষ্টায় নামে সে। আর কোনো উপায় না দেখে মনে প্রবল সাহস সঞ্চার করে ডান হাত কেটেই তবে মুক্তি পায় সেই মৃত্যুকূপ থেকে। এরপর কয়েক মাইল হেঁটে মানুষের সন্ধান পায় সে এবং তাদের সহায়তায় হাসপাতালে পৌঁছায়।
অ্যারনের এখন ছেলে হয়েছে, সংসার হয়েছে। তবে পর্বতারোহণের নেশাটা যায়নি। এখন আর সে ভুল করে কাউকে গন্তব্যের ঠিকানা না বলে যায় না। জীবিত অ্যারন এখন গোটা বিশ্বের মানুষের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
ছবিটি ২০১১ সালের অস্কারের জন্য ছয়টি বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল এবং জিতেছিল সে বছরের এএফআইসহ অনেক পুরস্কার।