অতল জলের গানে

‘জলের গান’-এর পাঁচ সদস্য—মিঠু, সঞ্জয়, জার্নাল,
‘জলের গান’-এর পাঁচ সদস্য—মিঠু, সঞ্জয়, জার্নাল,

‘ও ঝরাপাতা গো, তোমার সাথে আমার রাত পোহানো কথা...।’ ‘জলের গান’-এর সদ্য বের হওয়া প্রথম অ্যালবামের গান এটি। এই আড্ডা বারবার ঘোরাঘুরি করেছে সেই অ্যালবামের চৌহদ্দিতে... ‘এসো নিজে করি’—কথাটি লেখা হয়েছে যেন গানের দল ‘জলের গান’-এর জন্যই। কেন? উত্তর পাওয়া যাবে একটি দৃশ্য বর্ণনায়: শনিবার সন্ধ্যায় আমরা যখন রূপনগরে জলের গানের স্টুডিওতে পৌঁছালাম, দেখি, গোল হয়ে বসে নিজেদের প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম অতল জলের গান-এর সিডিগুলো মোড়কবন্দী করছেন সদস্যরা। কেউ বা আবার সেই মোড়কবন্দী সিডিতে স্টিকার লাগাচ্ছেন। এর মধ্যে দলের সদস্য জার্নাল বললেন, ‘গান লেখা, গাওয়া থেকে শুরু করে সিডি বের করা এবং তার প্রচারণা—সবই আমরা নিজের হাতে করেছি, বুঝেছেন?’ হাতেনাতে যখন প্রমাণ মিলছে, তখন না বুঝে উপায় আছে! অন্যান্য দলের চেয়ে এরা একটু ভিন্নপন্থী। তারা যেমন সংগৃহীত, তাদের ভাষায় ‘কুড়োনো গান’ ও নিজেদের লেখা গান করে, তেমনি প্রচলিত বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি নিজেদের উদ্ভাবিত চন্দ্রবান, তারাবান, নয়নতারাসহ বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র বাজায়। তাদের সঙ্গে যেদিন কথা হচ্ছে, তার আগের দিনই নতুন একটি বাদ্যযন্ত্রের জন্ম দিয়েছে তারা। নতুন এই বাদ্যযন্ত্রের নাম দেওয়া নিয়েও তখন চলছে ধুন্ধুমার উত্তেজনা। কিন্তু আমাদের এই আড্ডা তো তাদের প্রথম অ্যালবামকে ঘিরে। হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখের দুই দিন আগে ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে জলের গানের প্রথম অ্যালবাম অতল জলের গান। অ্যালবামটি ‘মাল্টিমিডিয়াম রিলিজ’ দিয়েছে তারা। কীভাবে? ‘১২ তারিখ দুপুরে মাছরাঙা টেলিভিশনে আমাদের গানের অনুষ্ঠানে অতল জলের গান-এর মোড়ক খুলেছেন আইয়ুব বাচ্চু। একই সঙ্গে ওয়েবসাইটেও রিলিজ হয়েছে অ্যালবামটি। এরপর সদ্য প্রকাশিত অ্যালবাম সঙ্গে নিয়ে গান গেয়েছি চারুকলার খোলা মঞ্চে। চারুকলা তো আমাদের নিজেদের উঠোন। তাই অ্যালবাম প্রকাশের দিন এখানে আসব না, তা কি হয়! তার পরই এবিসি রেডিওতে গান গেয়ে আবারও উদ্যাপন করেছি অ্যালবামের রেডিও প্রকাশনা। একসঙ্গে এ সবকিছুকেই আমরা বলছি মাল্টিমিডিয়াম রিলিজ। এ ছাড়া আরও যদি অন্য কোনো মিডিয়াম পেতাম, তবে সেখানেও প্রকাশ করতাম সিডিটি।’—রাহুল আনন্দ কথা বলছিলেন কাজের ফাঁকে। সেদিনের আড্ডায় গরহাজির জলের গানের তিন সদস্য—দেশের বাইরে থাকায় পাওয়া গেল না কনক আদিত্যকে। এ ছাড়া আসি আসি করেও ফাঁকি দিলেন জ্যাম ও শ্যামল। আরেক সদস্য রানা এলেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে ফটোসেশন শেষ। শেষ পর্যন্ত আড্ডা হলো রাহুল আনন্দ, জার্নাল, রানা, মিঠু, সঞ্জয় ও শরীফের সঙ্গে। ‘গান নিয়ে ব্যবসা করব না’ বলতে বলতে হঠাৎই বাজারে এল অতল জলের গান...। ‘আমরা কিন্তু আসলেই গান নিয়ে ব্যবসা করিনি। অ্যালবামের দাম রেখেছি মাত্র ৩৫ টাকা। চাইলে যে কেউই বিনা মূল্যে পুরো অ্যালবামটি www.jolergaan.com ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করতে পারছেন।’—আমাদের প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই বলে গেলেন সঞ্জয়। এবার হঠাৎ অ্যালবাম বের করার কারণগুলো শুনুন রাহুলের কাছ থেকে।  ‘২০০৬ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর মানুষের মুখে মুখেই পরিচিতি পেয়েছে আমাদের গানগুলো। “দূরে থাকা মেঘ”, “বন্ধু”, “উড়ছি কেন?”, “ঝরাপাতার গান” কিংবা “কাগজের নৌকা”—এ গানগুলো খুব দ্রুতই সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। নাট্যনির্মাতা শহীদুজ্জামান সেলিম তাঁর বেশ কিছু নাটকে আমাদের গান ব্যবহার করেছেন। এ কারণে গানগুলো ঢাকার বাইরেও ছড়িয়েছে। সেলিম ভাই একসময় আমাকে বলেছিলেন, “তোরা অ্যালবাম বের কর, আমি টাকা দিচ্ছি।” করিনি। পরে ২০১২ সাল থেকে যখন নিয়মিত মঞ্চ ও টেলিভিশনে গাওয়া শুরু করলাম, তখন দেখি, লোকজন মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে আমাদের গান রেকর্ড করছে, টেলিভিশন থেকে রেকর্ড করছে! এর মধ্যে অনেকে আবার আমাদের কাছ থেকেও গানগুলো সংগ্রহ করেছে। সব মিলিয়ে শ্রোতাদের চাপ ছিল। তা ছাড়া আমাদেরও মনে হলো প্রামাণ্যকরণের জন্য হলেও এবার নিজেদের একটি অ্যালবাম করা দরকার। তাই এ বছরের মার্চে ফেসবুকে জলের গানের গ্রুপ পেজে ঘোষণা দিলাম, আমরা অ্যালবাম বের করব। সঙ্গে সঙ্গে অনেক সাড়া।’ রাহুলের কথা ফুরোয়নি, এরপর আবারও বলবেন তিনি; কিন্তু তার আগে মিঠু ঢুকে পড়েছেন দুই লাইনের কথা নিয়ে, ‘একজন ফেসবুকে হুমকির মতো করে লিখল, “বকুল ফুল যেন থাকে।” আরও কত আবদার...।’ ‘মাত্র এক মাসের মধ্যে অ্যালবাম তৈরি হলো। শেষে ক্যাচাল বাধল অ্যালবামের নাম নিয়ে। অনেক নামের মধ্য থেকে মনঃপূত হলো দুটি নাম—“খাঁচার পাখির গান” ও “অতল জলের গান”। দুই নামের কোনটা রাখব—সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে শেষমেশ ফেসবুকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দিয়েছিলাম শ্রোতাদের হাতে। তাঁরা “অতল জলের গান” নামটিকে জয়যুক্ত করেছেন।’অনেক দোদুল্যমানতার পর প্রথমবার প্রথম অ্যালবামের এক হাজার কপি সিডি বের করেছিল জলের গান। কিন্তু অবাক কাণ্ড—প্রথম দিনেই এক হাজার কপি ফুড়ুৎ! এরপর পনেরো শ। তা-ও যখন শেষ, তখন তৃতীয় কিস্তিতে একবারে সাত হাজার সিডি করেছে তারা। ওয়েবসাইট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মানুষ জলের গানের পুরো অ্যালবাম শুনেছেন। আর অ্যালবাম ডাউনলোড করেছেন প্রায় তিন হাজার শ্রোতা।

এই তথ্যগুলোর জোগানদার রাহুল আনন্দ। জলের গানের অন্যতম কান্ডারি তিনি। বলেন, ‘ঢাকার বাইরের মানুষ যাতে আমাদের গান শুনতে পারে, সে জন্য সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শতাধিক ছেলেমেয়ে আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। এ ছাড়া ঢাকায় অতল জলের গান পাওয়া যাচ্ছে দেশাল ও যাত্রার শোরুমে। যেকোনোভাবে মানুষের কাছে আমাদের গানগুলো পৌঁছাতে চাই আমরা। আসলে অ্যালবাম বের করে ফেলার পর তো আমরা কেউ না, আমরা নিমিত্ত মাত্র—এটি এখন মানুষের সম্পদ।’
এমনভাবে কথা বলছেন রাহুল, যেন পাততাড়ি গোটাতে হবে এখনই। তাই তাঁকে বলা হলো, চলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আড্ডাটা এবার শুরু করি। ‘এতক্ষণ তাহলে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা চলল নাকি!’—রাহুলের এই কথার পর সবার মুখে একচোট হাসি। তারপরও আমাদের সঙ্গে জলের গানের রাত পোহানো কথা চলছিলই...।