আমার বাউণ্ডুলে দিন

মোশাররফ করিম যখন তারকা
মোশাররফ করিম যখন তারকা

যে জীবন পেরিয়ে এলাম, সেখানে কত কত স্মৃতি! কিন্তু এক জীবনের স্মৃতির কুণ্ডলীর মধ্যে বারবার উচ্ছল হয়ে ওঠে ছেলেবেলা। হায়রে ছেলেবেলা—আমার বাউণ্ডুলে দিন, তাকে কেমন করে ভুলে থাকি! শৈশব-কৈশোর যেন ষোলগুটি হয়ে কেবলই উছলে ওঠে আমার ভেতরে। আমি তারে পারি না এড়াতে, সে এসে হাত রাখে হাতে। তাই ছেলেবেলার কথা মনে হলে ছবির মতো ভেসে ওঠে অসংখ্য দৃশ্য, অজস্র স্মৃতি।

লেখাপড়ায় হাতেখড়ি
আমি তখনো স্কুলে ভর্তি হইনি। আমাদের বাড়িতে ছিলেন একজন গৃহশিক্ষক। তাঁকে আমরা বলতাম সুলতান কাকু। তাঁর হাতেই লেখাপড়ায় আমার হাতেখড়ি। ঢাকায় আমাদের বাড়িতে থাকতেন তিনি। আমরা সে সময় থাকি গোড়ানে। যে বাসায় থাকতাম, সেটা একটু পুরোনো আমলের একতলা। বারান্দায় মোটা মোটা গোলাকার থাম, সামনে প্রশস্ত উঠান। পুরো বাসা বাউন্ডারি ঘেরা। তো, সুলতান কাকু ছিলেন খুব কড়া। লেখাপড়ার ব্যাপারে নিয়মনিষ্ঠ। বাড়িতে আমাদের সব ভাইবোনকে অনেকটা স্কুলের মতো করে সাপ্তাহিক, মাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা নিতেন তিনি। এখানে বলে রাখি, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আমি কাকুর কাছেই পড়েছি। তাঁর কাছেই আমার হাতের লেখা শেখা।

চালাকি ও চৌর্যবৃত্তি
সন্ধ্যাটা ছিল আমি ও আমার ভাইবোনদের হাতের লেখা লেখার সময়। তবে সেই শৈশবে হাতের লেখা লিখতে আমার একদমই ভালো লাগত না, খুবই অপ্রয়োজনীয় মনে হতো কাজটিকে। তাই হাতের লেখা লেখার জন্য চলে যেতাম পাশের ঘরে। আমার ভাইবোন যখন সুলতান কাকুর সামনে বসে লেখে, তখন আমি চলে যাই পাশের ঘরে। পাশের ঘরে কেন যেতাম সেটি বলতে হলে চৌর্যবৃত্তি ও চালাকির কথাটিও বলতে হবে।

আমরা হাতের লেখা লেখার পর সেই খাতাটি স্বাক্ষর করতেন সুলতান কাকু। স্বাক্ষর করতেন কাঠপেনসিল দিয়ে। হাতের লেখা লেখার নাম করে আমি প্রতিদিনই অন্য ঘরে গিয়ে ইরেজার দিয়ে ঘষে কাকুর স্বাক্ষরটি তুলে ফেলতাম। তারপর খাতাটি এগিয়ে দিতাম তাঁর সামনে। তিনি ধরতে পারতেন না এ চুরি ও চালাকি। এভাবে হরহামেশা আগের দিনের পুরোনো হাতের লেখাই জমা দিতাম আমি। এই চুরিবিদ্যায় আমার খুশির সীমা নেই। কারণ, আমার ভাইবোন প্রতিদিন কষ্ট করে হাতের লেখা লিখছে আর চমৎকার চালাকি ও চুরিবিদ্যার কারণে পার পেয়ে যাচ্ছি আমি। আমাকে দেখে ভাইবোনেরা তো অবাক! তাঁরা ভাবে, এত দ্রুত আমি লিখি কী করে?

দশ দিন চোরের একদিন গৃহস্থের—ধরা পড়ে গেলাম একসময়। খাতার একই জায়গায় থাকা সুলতান কাকুর স্বাক্ষর দিনের পর দিন মুছতে মুছতে একসময় কালো হয়ে গেল জায়গাটি। ফলে তিনি ধরে ফেললেন আমার চুরি। এরপর যা হয়—ব্যাপক উত্তমমধ্যম। সেদিনের শাস্তিটি ছিল ভয়াবহ।

তারকা হওয়ার আগে
তারকা হওয়ার আগে

লেটার প্রেসের ঘটাং ঘটাং, স্বাধীনতা...
শৈশবে দুপুরবেলা আমাদের ঘুমাতে হতো সুলতান কাকুর তত্ত্বাবধানে। আমাদের পাহারা দিতে দিতে একসময় তিনি নিজেই নাক ডাকতেন। আমি তখন চুপিচুপি বাড়ির প্রধান ফটক টপকে বের হয়ে যেতাম বাইরে। দুপুরবেলা চারপাশ সুনসান, লোকজন খুব একটা নেই—এভাবেই প্রতিদিন দুপুরগুলো আমার জন্য নিয়ে আসত অবাধ স্বাধীনতা। মনে পড়ে, গোড়ানে আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল একটা লেটার প্রেস। সেই লেটার প্রেসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। প্রেসের একটানা ঘটাং ঘটাং শব্দ, মেশিন চলছে, ছাপা হচ্ছে কাগজ—এটা সেই ছেলেবেলায় খুবই বিস্মিত করত আমায়। প্রতিদিনই পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতাম। আবার কখন লেটার প্রেসে ছাপা দেখব, ঘটাং ঘটাং শব্দে পাব স্বাধীনতার স্বাদ। এভাবে দুপুরবেলা ঘোরাঘুরি শেষে সুলতান কাকু ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই ঘরে ফিরে সুবোধ বালকের মতো শুয়ে পড়তাম। তখন পড়াশোনায় আমার কোনো মন ছিল না।

সুলতান কাকুর শাস্তি

পড়ালেখা অবশ্য সুলতান কাকুর ঘরেই করতে হতো। ঘরের কোনায় একটা খাটের ওপর বসে আমাদের পড়াতেন কাকু। আমরা বসতাম মেঝেতে। শাস্তি দিতে হলে খাট থেকে নামার কষ্ট যাতে না করতে হয়, সে জন্য লম্বা একটা বেত ছিল তাঁর। বিষয়টি এমন যে যত দূরেই শিক্ষার্থীরা থাকুক না কেন, বেত্রাঘাত করতে যাতে অসুবিধা না হয়। তবে এ কথাও বলতে হবে, সুলতান কাকু খুব ভালোবাসতেন আমাদের।

ছেলেবেলায় আরেকটা শাস্তি দিতেন সুলতান কাকু—তাঁর খাটের নিচে মাথা ঢুকিয়ে রাখা। আমাকে সব সময় অবশ্য কাকুর শাস্তি থেকে বাঁচাতেন আমার দাদু।

রোল নম্বর পঞ্চান্ন
আমার স্কুলের দিনগুলো ছিল
অসাধারণ। প্রথম প্রথম স্কুলে গিয়ে শ্রেণিশিক্ষকের ছাত্রদের নামডাকা দেখে আমি তো অবাক! এক বললে একটা ছেলে লাফ দিয়ে ওঠে, দুই বললে আরেকজন বলে ‘প্রেজেন্ট স্যার’—এসব কী! ভাবি, শ্রেণিশিক্ষক নাম না বলে এক, দুই, তিন, চার... বললে সবাই এমন লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে কেন? এত দিন বাড়িতে পড়ালেখা করেছি, সেখানে তো এসবের বালাই ছিল না। আসলে স্কুলের নামডাকা বিষয়টার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিলাম না। মজার ব্যাপার হলো, স্কুলজীবনের প্রথম দিকে নিজের রোলও জানতাম না আমি। আমার রোল ছিল পঞ্চান্ন। হররোজ শিক্ষক ‘রোল নম্বর পঞ্চান্ন’ বলে আমায় ডাকছেন অথচ আমি লাফ দিয়ে উঠে জবাব দিচ্ছি না।
স্কুলে আমার বন্ধু ছিল সন্ধ্যা নামের এক মেয়ে। একদিন সে-ই ধরিয়ে দিল বিষয়টি। স্কুলে আমি যে কোনো দিন ‘প্রেজেন্ট স্যার’ বলি না, স্যারকে সে বলে দিল সেটি। তখন হাজিরা খাতায় দেখলাম একেকটি সংখ্যার পাশে লেখা আছে একেকজনের নাম। আমার নামটি পঞ্চান্ন নম্বর সংখ্যায় রূপান্তরিত হলো এভাবেই।

বন্ধুদের সঙ্গে মোশাররফ করিম (বাঁ থেকে প্রথম)
বন্ধুদের সঙ্গে মোশাররফ করিম (বাঁ থেকে প্রথম)

উচ্চশিক্ষার্থে গ্রামযাত্রা...
আগেই বলেছি, ছেলেবেলায় পড়ালেখায় কোনো রকম মনোযোগ ছিল না আমার। ফলে যখন চতুর্থ শ্রেণির শেষ দিকে রয়েছি—ফাইনাল পরীক্ষা আসি আসি করছে, সে সময় একদিন হুট করে শহরের পাট চুকে গেল আমার। শহরে আমার পড়াশোনায় মন নেই। কেবলই ঘোরাঘুরি করি। এ ছেলেকে দিয়ে হবেটা কী—এই দুশ্চিন্তায় উচ্চশিক্ষার্থে আমায় আমাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে পাঠিয়ে দিলেন মা-বাবা।
গ্রামের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। গ্রামের বাড়ির সামনে মাটির রাস্তা, প্রকাণ্ড শিমুলগাছ, নদী—সবকিছু খুব মায়াময় মনে হতো। কিন্তু আমাকে যখন লেখাপড়ার জন্য গ্রামে পাঠানো হলো, মুহূর্তেই গ্রামটি দুর্বিষহ হয়ে উঠল আমার কাছে। গ্রামের মায়াময় দৃশ্যগুলো কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল। শাসনের বাঁধনে শৃঙ্খলিত হলাম আমি। সেই শৃঙ্খল থেকে আজও কি মুক্তি মিলেছে?

বাবার জন্য অপেক্ষা

স্কুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে—স্কুলের বাইরে খাল, খালের পরে বিস্তীর্ণ জমি, এসব দেখতাম। গ্রামে থাকার সময় বাবার জন্য খুব খারাপ লাগত; কিন্তু মায়ের জন্য সে রকম অনুভূতি হতো না। এর প্রধান কারণ, মা মারতেন, বাবা মারতেন না। আমাকে অনেক বেশি বুঝতে পারতেন বাবা। মনে আছে, গ্রামের নদীপারে কত দিন বাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছি—কখন ঢাকা থেকে লঞ্চ ভিড়বে ঘাটে, ঘাট থেকে নামবেন বাবা!

অনুলিখন: আলতাফ শাহনেওয়াজ