অমিতাভের কাছাকাছি

অমিতাভ বচ্চন
অমিতাভ বচ্চন

অমিতাভ বচ্চনের জীবনী লিখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা ১৯৮৬ সাল। অমিতাভ হিসাব করে বলেছিলেন, একই প্রস্তাব এর আগেও তিনি পেয়েছেন ১২ বার। তার পরও একসময় সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়কেই জীবনী লেখার ভার দিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে সে বই প্রকাশিত হয় কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এরপর কাজের সূত্রেই বহুবার অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা হয়েছে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁরই কিছু কথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে তিনটি লেখা লিখছেন প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ ছাপা হলো প্রথম কিস্তি

আশির দশকের গোড়ায়, যখন তিনি বলিউডের ‘ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি’ বিশেষণ পেয়ে গেছেন, এক বিখ্যাত ফিল্ম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সিনেমায় সফল না হলে তিনি কী করতেন। অমিতাভ বচ্চন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এলাহাবাদে ফিরে গিয়ে দুধ বেচতাম।’ অবশ্যই ঠাট্টা। তার বছর কয়েক পর এক ঝমঝম বর্ষার রাতে মুম্বাইয়ের জুহুতে তাঁর বাংলো ‘প্রতীক্ষা’য় বসে সেই পুরোনো প্রশ্নটা যখন নতুন করে পেড়েছিলাম, দৃশ্যত বিব্রত উনি বলেছিলেন, ‘ওটা ছিল আমার হতাশা। একটার পর একটা সিনেমা ফ্লপ করছিল যখন, সত্যিই তখন মনে হয়েছিল, এর থেকে বোধহয় দুধ বেচাও ভালো।’ আমি কথা ঘুরিয়েছিলাম, ‘অভিনয়ে সাফল্য না পেলে দুধ আপনি নিশ্চয়ই বেচতেন না, কিন্তু প্ল্যান কিছু ছিল কি?’ জানালার কাচে ঝমঝমে বৃষ্টির বিচিত্র আঁকিবুঁকির দিকে তাকিয়ে তিনি ঠোঁট উল্টে বলেছিলেন, ‘না। তবে আজ মনে হয়, সাংবাদিক হলে বেশ হতো। তোমাদের কী বিপুল স্বাধীনতা; যা খুশি লিখতে পারো, রাজা-উজির মারতে পারো। কারও কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।’
সেই কথাবার্তার প্রায় দুই দশক পর যখন তিনি ভারতীয় বিনোদন জগতের অবিসংবাদী ভীষ্ম পিতামহ রূপে পরিচিত, সে সময় আরও একবার দেখা এবং কী আশ্চর্য, সেদিনও ভোর থেকে আকাশভাঙা বৃষ্টি। ভিজে সপসপে রাজধানীতে নেমেই তিনি মুঠোফোনে জানান দিলেন। দেখা হলো পাঁচতারার শীত শীত সান্নিধ্যে। কাজ-অকাজের কথাবার্তার পর প্রথমে দুধ বেচা ও তার পরে তাঁর সাংবাদিক হওয়ার বাসনার বিষয়টি পেড়েছিলাম। উনি ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো এখনো মনে করি, সাংবাদিকতা পেশাটি দারুণ ইন্টারেস্টিং। তোমরা কত কিছু করতে পারো, তোমাদের কলমের ছোঁয়ায় ওলট-পালট ঘটে যেতে পারে, তোমরা কাউকে তোয়াক্কা করো না, তোমাদের কী বিপুল স্বাধীনতা। লোকে তোমাদের ভয় যেমন করে, তেমন তোয়াজও করে।’
আমি মিনমিনে প্রতিবাদ করে বলি, ‘যতটা বলছেন, বাস্তব কিন্তু ঠিক তেমন নয়। অবশ্য এটা ঠিক, আপনার লেখা এত স্বচ্ছ, এত স্পষ্ট, এতই প্রাঞ্জল যে সাংবাদিকতায় গেলেও আপনি এভাবেই রাজত্ব করতেন। আমি এখনো ইলাস্ট্রেটেড উইকলির সেই লেখাটি ভুলতে পারিনি, যাতে আপনি বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে এক্সপোজ করতে চেয়েছিলেন। আমি তো মনে করি, ওই লেখাটি ছিল আ পিস অব লিটারেচার।’
প্রশংসা অমিতাভকে সংকুচিত করে। বিব্রতও। উনি উশখুশ করতে লাগলেন। আমি কথা ঘোরানোর ঢঙে বলেছিলাম, ‘আপনার এনার্জি লেভেল আমার মতো অগুনতি মানুষকে হতবাক করে। যত রাতই হোক, আপনি যাঁদের আপনার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি মনে করেন, তাঁদের জন্য নিজের মনের কথা লেখেন, তাঁদের সঙ্গে কমিউনিকেট করেন একেবারে নিজের ঢঙে, খোলামেলা। একটা দিনও আপনি বাদ দিতে চান না। এত ডেডিকেটেড। আর প্রতিটি লেখাই অপূর্ব।’
অমিতাভের অস্বস্তি বেড়ে যাচ্ছিল, আমার মজা লাগছিল। তিনি পাশ কাটাতে বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক তো আর হওয়া হলো না, তাই ব্লগ লেখা। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি।’
আমি হাই হাই করে উঠি। বলেন কী বলেন কী ঢঙে বলি, ‘আপনি যে শুধু সাংবাদিকতাই করছেন তা নয়, আপনি রীতিমতো ব্রেকিং স্টোরি দিয়ে যাচ্ছেন।’
অমিতাভ চোখ ছোট করে ও কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে আমায় দেখলেন। সেই চাহনিতে মুঠোমুঠো বিস্ময়।
আমি হেঁয়ালিকে পাশ কাটিয়ে বললাম, ‘ঐশ্বর্যের মা হতে যাওয়ার খবরটা তো আপনারই লেখা স্যার! আপনি না জানালে তো আরও বহুদিন অপেক্ষায় থাকতে হতো! এটা যদি ব্রেকিং নিউজ না হয়, তা হলে ব্রেকিং কোনটা?’
অমিতাভ বচ্চনের চোখ দুটো বড় হলো, কোঁচকানো ভ্রু সোজা হলো, চাহনি হলো স্থির। দুহাতের দশ আঙুল একে অন্যের ফাঁকে আশ্রয় পেয়ে এলিয়ে রয়েছে। অপলক তিনি চেয়ে রইলেন আমার মুখে।
আমি খেয়াল করলাম, তাঁর ডান হাতের কবজিতে গেরুয়া সুতোর পবিত্র তাগা বাঁধা নেই, দশ আঙুলে অন্তত পাঁচটি আংটি ছিল, প্রতিটি মিসিং! একটা ইয়া বড় মুনস্টোন, একটা নীলা, একটা হিরে, একটা বড়সড় পোখরাজ, একটাও নেই! একটা সাধারণ আংটিও যেন ছিল, ছাই ছাই রঙের। গেল কোথায় ওগুলো? এমন আংটিহীন আঙুল তো কখনো দেখিনি? হলোটা কী মানুষটার? একেবারে নাস্তিক হয়ে গেলেন অমিতাভ বচ্চন? এটাই তো তাহলে ব্রেকিং নিউজ?
‘না না, ওগুলো সব আছে, সব আছে’ বলে আমার বিস্ময়কে একেবারে পাত্তা না দিয়ে অমিতাভ নড়েচড়ে বসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে আমার বাঁ কাঁধটায় চাপ দিয়ে বললেন, ‘সাংবাদিক হতে পারলাম কি না তার চেয়ে বড় কথা, অনেক সাংবাদিকের গালগল্প করার অভ্যাসটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি। ব্লগের মাধ্যমে আমাদের কথা আমরাই জানাচ্ছি। আজ অনেক দিন হলো আমাদের নিয়ে নো গসিপ, নো রিউমার, নো স্পেকুলেশন।’
এ কথা বলা ও শোনার পর আমরা দুজনে দুজনের হাত ধরে বেশ একচোট হেসেছিলাম।