বাংলাদেশ তাঁকে স্মরণ করবে

গোবিন্দ হালদার (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০–১৭ জানুয়ারি ২০১৫)
গোবিন্দ হালদার (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০–১৭ জানুয়ারি ২০১৫)

তাঁকে মনে রাখার জন্য ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু গোবিন্দ হালদারের গানের খাতায় ছিল ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’র মতো গানও। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ গানগুলো যখন বাজত, তখন উজ্জীবিত হতো বাংলার মানুষ। তাঁর প্রয়াণে শোকাভিভূত বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংস্কৃতিসেবীরা স্মৃতিচারণা করলেন এই অমর গীতিকারের...
কামাল লোহানী
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকার সময় তাঁর কিছু গান সংগ্রহ করেছিলাম। বন্ধু কামাল আহমেদের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। প্রায় ৩০টির মতো গান তিনি দিয়েছিলেন। তাঁর যে গানগুলো সে সময় প্রচারিত হয়েছিল, সে জন্য কোনো সম্মানী তাঁকে আমরা দিতে পারিনি। পরে কলকাতায় যখনই গিয়েছি, তাঁকে অসুস্থ দেখেছি। তাঁর চিকিৎসার জন্য শিল্পী বন্ধুবান্ধবদের পক্ষ থেকে কিছু টাকা আমরা পাঠিয়েছিলাম।
সুজেয় শ্যাম
গোবিন্দ হালদারের গানের খাতাটি কামাল নামে এক ভদ্রলোকের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কামাল লোহানীর কাছে পৌঁছে যায়। সমর দাসকে খাতাটা দেন কামাল লোহানী। এরই মধ্যে আপেল মাহমুদ ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ গানটিতে সুর করেন। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটি সুর করেন সমর দাস। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর অসংখ্য গান বাংলার মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। গোটা বাংলাদেশ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
আপেল মাহমুদ
সমর দাস আমাকে গোবিন্দ হালদারের খাতাটি দেন। জুলাইয়ের শেষের দিকে ‘হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার’ গানটিতে আমি প্রথম সুর করি। এরপর আশরাফুল আলমকে দেখাই। এরপর সুর করি ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’ গানটি। ‘আগুন আগুন’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ সুর করি। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরের দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কলকাতার নিউমার্কেটের সামনে। বেশ কয়েকজন মিলে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। সবাইকে আপ্যায়ন করালেন গোবিন্দ হালদার। ঘণ্টা খানেক আলাপ-আলোচনা হয়। এরপর অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। শেষ দেখা ১৯৯৬ সালে। এয়ারপোর্টে বিদায় দেওয়ার সময়।
আবদুল জব্বার
তাঁর কোনো গান আমার গাওয়া হয়নি। তবে তাঁর সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার দেখা হয়েছিল। এমন একজন মানুষের মৃত্যুতে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। বাংলাদেশের শিল্পীদের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি।
কল্যাণী ঘোষ
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটি প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই। আমরা কয়েকজন কণ্ঠ দিয়েছিলাম। গানটির এত চমৎকার কথা! কালজয়ী এই গানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে কিন্তু তাঁর গান করেছি, এ কথা ভাবলে এখনো রোমাঞ্চিত হই।
রফিকুল আলম
জুলাইয়ের শেষের দিকে যখন আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাই, তত দিনে ‘পূর্ব দিগন্তে’ গানটি হয়ে গেছে। পরে তাঁর ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানটি গাইতে একদিন তাঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। গানটির সুর করেছিলেন আপেল মাহমুদ। প্রধান কণ্ঠ ছিল স্বপ্না রায়ের। আর আমরা অনেকে কোরাস গেয়েছিলাম। সেদিনই তাঁকে কাছ থেকে দেখেছিলাম।
অরূপ রতন চৌধুরী
শুধু গান লিখেই তিনি থেমে থাকেননি। যুদ্ধ করার জন্যও তিনি উদগ্রীব থাকতেন। তিনি ভারতের নাগরিক, কিন্তু বাংলাদেশকে নিজের দেশ মনে করতেন। কবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, তা নিয়ে খুব রোমাঞ্চিত হতেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ গানগুলো তাঁরই লেখা।
রূপা খান
আমি তাঁর ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছি। এটা আমার সৌভাগ্য। গানটিতে বাংলাদেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। সৌভাগ্য। আফসোস, যে মানুষটার চমৎকার গানে কণ্ঠ দিয়েছি, তাঁর সঙ্গে আর দেখা হলো না।
মালা খান
আমরা কয়েকজন মিলে ‘পূর্ব দিগন্তে’ গানটি করেছিলাম। বাংলার মানুষ তাঁকে গর্বভরে সব সময় স্মরণ করবে।
গ্রন্থনা: মনজুর কাদের ও প্রণব ভৌমিক