এক ঝলকে দশ নাটক

বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী দিনে মঞ্চে (বাঁ থেকে) সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার l ছবি: সাহাদাত পারভেজ
বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী দিনে মঞ্চে (বাঁ থেকে) সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার l ছবি: সাহাদাত পারভেজ

দেখুন তো, কল্পনা করতে কেমন লাগে? ধরুন, মঞ্চে কোকিলা চরিত্রে অভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। একটু আগে রক্তকরবী নাটকের রাজা চরিত্রটিকেও নিয়ে এসেছিলেন আতাউর রহমান। নন্দিনীও ছিল সঙ্গে। আরজ আলী মাতুব্বর চরিত্রে তারিক আনাম খান তর্ক করছেন একজন পুলিশের সঙ্গে। একটু পর মঞ্চে উঠলেন মোমেনা চৌধুরী লাল জমিন নাটক নিয়ে।
হয়তো ভাবছেন, একসঙ্গে এতগুলো নাটক কেবল কল্পনাতেই সম্ভব। গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে দর্শকেরা কিন্তু একসঙ্গে দেখতে পেলেন নাটকগুলো। বাংলা একাডেমির ৬০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের তৃতীয় বা সমাপনী দিন ছিল গতকাল বুধবার। সমাপনী দিনের শেষ অধিবেশনে পরিবেশিত হলো থিয়েটারের নাটক কোকিলারা, নাগরিকের রক্তকরবী, সময়ের কবর, নাট্য কেন্দ্রের আরজ চরিতামৃত, আরণ্যকের রাঢ়াং, ঢাকা থিয়েটারের ধাবমান, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের আমেনা সুন্দরী, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের সুদূরে দিগন্ত, চারুনীড়মের ডেড পিকক, শূন্যনের লাল জমিন। মোট ১০টি নাটক, অধিবেশনের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের এক ঝলক’। প্রতিটি নাটকের একটি করে দৃশ্য অভিনয় করলেন শিল্পীরা। পুরো পর্ব সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল মফিদুল হকের ওপর। রবীন্দ্রনাথ, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীনসহ অনেকের লিখিত নাটকগুলোর এমন পরিবেশনার আগে হয় নাটক নিয়ে আলোচনা। এ অধিবেশনটি শুরুর দায়িত্বে থাকা আতাউর রহমান বলেছিলেন, নাটকের ভূমিকা দুরকম। একটি সাহিত্য হিসেবে পাঠ, আরেকটি পরিবেশনা। নাটক সাহিত্য কি সাহিত্য নয় এ প্রসঙ্গও এল তখন। কলকাতায় মোহিত চট্টোপাধ্যায় একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য যদি সাহিত্য না হয়, তবে নাটক কেন টেক্সট হিসেবে সাহিত্য বলে গণ্য হবে? অধিবেশনে অশোক মুখোপাধ্যায়, মামুনুর রশীদেরা নাটককে সাহিত্য হিসেবে গণ্য করে যুক্তি দেখান, শেক্সপিয়র, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটক অবশ্যই সাহিত্য। সৈয়দ শামসুল হক বলেন, জাপানে আকিরা কুরোসাওয়া, সুইডেনে ইঙ্গমার বার্গম্যান, রোমে লুইগো বার্তোলিনির লেখা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য সাহিত্য হিসেবে পড়ানো হয়।
এ সময় অশোক মুখোপাধ্যায় কিছু স্মৃতিচারণা করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত সাত দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলনে অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে ভারত থেকে যে দলটি বাংলাদেশে এসেছিল, সে দলে ছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়ও। সে সময়ের কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘তখন এখানে আমরা দুটো নাটক করেছিলাম—চাঁদভাঙা মুখ ও রাজরক্ত। পরে রামপুরায় বিটিভিতে একটি নাটক রেকর্ডও করা হয়। এ সাহিত্য সম্মেলনে এসে সেসব দিনের কথা মনে পড়ছে।’
সকালের অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন রামেন্দু মজুমদার। তাঁর ‘প্লেরাইটিং ইন বাংলাদেশ: রিসেন্ট ট্রেন্ডস’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের নাট্যজগতের কতগুলো নামে উঠে এল মঞ্চনাটকের ইতিহাস ও বর্তমান। প্রবন্ধকার মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের মাসুম রেজা, সাইমন জাকারিয়াদের কাজের ধারা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ২৪ বছরে নাট্যচর্চা তেমন হতে পারেনি শাসকশ্রেণির বাধার কারণে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় দারুণ পরিবর্তন আসে।
এ অধিবেশনে আরও আলোচনা করেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর জেনারেল টবিয়াস বায়ানকোনে, অধ্যাপক আবদুস সেলিম ও তরুণ নাট্যকার সামিনা লুৎফা নিত্রা। নির্দেশক জামিল আহমেদ পরিবেশন করলেন আরেকটি প্রবন্ধ ‘কন প্লাস টেম্পাস ইন বাংলাদেশ: ফ্রম ড্রামাটিক টেক্সট টু পারফরম্যান্স টেক্সট।’
সন্ধ্যায় হয় সাহিত্য সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও রামেন্দু মজুমদার। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।