'ফেরা' দিয়ে ফেরা

অবসকিউর
অবসকিউর

বাড়ির গেটে শুয়ে থাকা ইয়া বড় দুটো জার্মান শেফার্ডের লকলকে জিব এড়িয়ে আমরা যখন অবসকিউরের স্টুডিওতে পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। স্টুডিওর ভেতর থেকে ভেসে আসছে একটি অতিপরিচিত গানের সুর ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’। সদাহাস্য টিপু ভাই সামনে এসে দাঁড়ালেন। পরবর্তী দিনের অনুষ্ঠানকে ঘিরে তখন স্টুডিওর ভেতরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। কিছু সময় পর একে একে বেরিয়ে এলেন রাজু (বেজ), রাজিব (লিড), শান্তনু (গিটার), রাব্বানিসহ (ড্রামস) ব্যান্ডের আরেক সদস্য বিনোদ (কি-বোর্ড)। দীর্ঘ চার বছর পর গত ঈদুল ফিতর সামনে রেখে অবসকিউর বের করেছে তাদের নতুন অ্যালবাম ফেরা। তাই শুরুতেই প্রশ্ন করি ব্যান্ডের দলনেতা ও ভোকাল সাইদ হাসান টিপুকে, ফেরার ফেরাটা কত সময়ের জন্য?
একটু ভেবেই তিনি বললেন, ‘১৯৮৬ সালে অবসকিউরের যাত্রা শুরু। আমরা সব সময় চেয়েছি অবসকিউর সমানতালে এগিয়ে যাক। দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, যার অন্যতম প্রধান ছিল ব্যান্ডের কিছু সদস্যের ক্যারিয়ার নিয়ে অস্থিরতা। তখন দু-একজন সদস্য বিদেশে পাড়ি জমায়। টানা ১০ বছর পর ২০০১ সালে ফেরাতে তোমায় অ্যালবাম দিয়ে আমাদের সফল প্রত্যাবর্তন ঘটলেও তার পরপরই আমরা আবার সদস্য-সংকটে পড়ে যাই। আবারও বিরতি। মাঝের সময়টায় আমরা আবার দারুণভাবে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। অপেক্ষায় থেকো, ইচ্ছের ডাকাডাকির পর আমাদের এ ফেরাটা আশা করছি দীর্ঘ সময়ের জন্যই হবে।’ কথাটার রেশ ধরে রাজিব বললেন, ‘অবসকিউর সব সময়ই চেয়েছে শ্রোতাদের ভিন্ন রকমের কিছু গান উপহার দিতে। সেটা আমরা পেরেছিও। ফেরা অ্যালবামের প্রতিটা গানেই রয়েছে ভিন্নতা। আর সে জন্যই হয়তো অ্যালবামটি আমাদের শ্রোতারা পছন্দ করেছেন। আমাদের ফেরাটাও হবে দীর্ঘ সময়ের জন্য।’
মূলত ১৯৮৬ সালে যাত্রা শুরুর পরপরই অবসকিউর তার এক আলাদা শ্রোতাগোষ্ঠী তৈরি করে নেয়। ‘মাঝ রাতে চাঁদ যদি’, ‘ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী’, ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’সহ অসংখ্য শ্রুতিমধুর গান গেয়ে অবসকিউর দারুণ জনপ্রিয় এক ব্যান্ডদলে পরিণত হয়। এ জনপ্রিয়তার মূলে ছিল অবসকিউরের অনন্য গায়কি আর স্বকীয়তা।
নিজেদের গানগুলো বেশির ভাগ সময়ই তাঁরা নিজেরা লিখে সুর করেন। তাঁদের সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ফেরাতেও এর খুব একটা ব্যত্যয় ঘটেনি, মোট দশটি গানের আটটিই তাঁরা করেছেন নিজেদের লেখা ও সুরে। টিপুর পাশাপাশি ফেরা অ্যালবামের জন্য গান লিখেছেন তাঁরই সহধর্মিণী শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ।
অ্যালবামের কোন গানকে ঘিরে আপনাদের একটু বেশি প্রত্যাশা ছিল? প্রশ্ন শেষ না হতেই স্টুডিওর এক কোণে চুপটি করে বসে থাকা রাজুর মুখে হঠাৎ কথা ফুটল, ‘ভাই, আপনি কি অ্যালবামের “জীবন” গানটা শুনেছেন? কিংবা “মাঝি”, “বৃষ্টি”?’ এত প্রশ্ন আমাকে সংকটে ফেলে দিতে পারে ভেবে রাব্বানি একটু এগিয়ে এলেন, ‘আসলে ভাই, ও যে কথাটা বোঝাতে চাইছে, তা হলো, অ্যালবামের প্রতিটি গানই চমৎকার।’
ব্যান্ডের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শান্তনু বললেন, ‘অবসকিউরের জন্ম আমার জন্মের আগে। রাজিব চাচ্চুর (ব্যান্ডের সদস্য রাজিব) কল্যাণেই আমি এ ব্যান্ডে। তাঁর প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। অবসকিউরে এসে আমি শিখছি। টিপু চাচ্চুর মতো একজন শিক্ষক পাওয়া আমার জন্য বিশাল ব্যাপার।’
এমন এক সহজ সমীকরণেই গেঁথে আছেন অবসকিউরের সদস্যরা। পরস্পরের মধ্যে দারুণ খুনসুটিগুলোই বলে দিচ্ছে তাঁদের সুদৃঢ় বন্ধনটির কথা। আর এ বন্ধনের ওপর ছায়া হয়ে বসে আছেন ব্যান্ডের দলনেতা সাইদ হাসান টিপু, কখনো বন্ধু হয়ে, কখনোবা একজন অভিভাবক হয়ে।
বর্তমান প্রজন্মের ব্যান্ডগুলো নিয়ে কিছুটা হতাশা ঝরে পড়ল টিপুর কণ্ঠে, ‘এদের বেশির ভাগেরই গান শেখার প্রতি আগ্রহ নেই। স্বল্প সময়ে তারকা হওয়ার লোভটা এদের প্রতিভা নষ্ট করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আজকের দিনের সাবিনা, রুনা লায়লা, সুবীর নন্দীর মতো শিল্পীদের ভবিষ্যতে আর দেখা যাবে না।’
কথায় কথায় রাত অনেক হয়ে গেল। নিজেদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমরাও পা বাড়ালাম ‘নিঝুম রাতের আঁধারে’।