অরুণ থেকে দীপু

মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস ‘দীপু নাম্বার টু’ অবলম্বনে একই শিরোনামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৬ সালে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অরুণ সাহা। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। দীপু চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে শিশুশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন অরুণ। ‘দীপু নাম্বার টু’ ছবির পাশাপাশি দীপু চরিত্রটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর সবাই অরুণকে দীপু নামেই ডাকা শুরু করেন।

‘দীপু নাম্বার টু’ ছবির দৃশ্যে অরুণ সাহা।
‘দীপু নাম্বার টু’ ছবির দৃশ্যে অরুণ সাহা।

এখন অরুণ ব্যস্ত আছেন সংগীত নিয়ে। ক্লাসিক্যাল মিউজিক একাডেমি অব ঢাকার হয়ে শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন জায়গায় অর্কেস্ট্রাল মিউজিক পারফর্ম করছেন। তিনি ক্ল্যাসিকাল গিটার ও ট্রামপেট বাজান। টিভি অনুষ্ঠানেও ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক পারফর্ম করেছেন। এখন পুরোদস্তুর গানের মানুষ হলেও, অভিনয়ের প্রতি ছোটবেলার সেই দুর্বলতা আজও কাটাতে পারেননি। আর তাইতো অভিনয়ে নিয়মিত হতে চান। ভালো গল্প ও চরিত্র পেলে ছোট কিংবা বড় পর্দায় অভিনয় করতে আগ্রহী তিনি। ইচ্ছা আছে ক্যামেরার পেছনেও কাজ করার। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন অরুণ সাহা।
দীপু চরিত্রের নেপথ্যে ...
দীপু চরিত্রে অভিনয়ের সময় আমার বয়স ছিল ১৩ বছর। ছবিটিতে অভিনয়ের আগে কখনোই অভিনয় করিনি। হঠাৎ করেই ‘দীপু নাম্বার টু’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাই। তবে প্রাথমিক বাছাইপর্বে আমি জানতাম না, ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করব। মোরশেদুল ইসলাম আমার স্ক্রিন টেস্ট নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কোন চরিত্রে অভিনয় করব। আমি বলতে পারিনি। পরে আমাকে দীপু চরিত্রের সংলাপ শোনাতে বলা হয়। তখন বুঝলাম, দীপু চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছি আমি। ভয়ে বুকটা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আমি অভিনয় করতে পারব তো! পরে মোরশেদুল ইসলামের সহায়তায় আমি অভিনয়টাকে আয়ত্তে আনতে পেরেছিলাম। শুটিংয়ের শেষ দিকে আমার অভিনীত সব দৃশ্য এক শটেই ওকে হয়ে যাচ্ছিল।
অরুণ থেকে দীপু হওয়ার অনুভূতি...
তখনকার অনুভূতি অন্য কোনো অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করার মতো নয়। সব জায়গায় পোস্টারে আমার ছবি দেখে খুব ভালো লাগত। লোকজন আমাকে দীপু নামে ডাকত। অনেক প্রশংসা করত। ‘দীপু নাম্বার টু’ জাপানের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত হলে জাপানে ভ্রমণেরও সুযোগ হয়েছিল। সব মিলিয়ে তখন সোনালি সময় পার করেছি আমি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার...
‘দীপু নাম্বার টু’ ছবি মুক্তির দুই-তিন বছর পর শিশুশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার হাতে ট্রফি তুলে দিয়েছিলেন, গলায় মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন মজার একটা ঘটনা ঘটেছিল। শেখ হাসিনা আমার গলায় মেডেল পরানোর সময় হঠাৎ মেডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। তখন ছেঁড়া ফিতায় গিট্টু লাগিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দেন তিনি। আমি অভিভূত হয়ে যাই। সে ঘটনা কোনো দিনও ভুলতে পারব না। আজও সেই গিট্টু দেওয়া ফিতাসহ মেডেল আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি।
অভিনয় থেকে নির্বাসন...

অরুণ সাহা
অরুণ সাহা


সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় চালিয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন। ‘দীপু নাম্বার টু’ ছবি মুক্তির পর আমি আর অভিনয়ের প্রস্তাব পাইনি তা কিন্তু নয়। বেশির ভাগ সময়েই দেখা যেত কোনো ছবির নায়কের ছোট বেলার চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হচ্ছে আমাকে। কিন্তু এমন চরিত্রে অভিনয়ে আগ্রহী ছিলাম না। এরপর পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অভিনয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমার স্কুল ছিল সেন্ট যোশেফ। এরপর ভর্তি হই নটরডেম কলেজে। কলেজ শেষ করে বুয়েটে ভর্তি হই। তবে বুয়েটে পড়া হয়নি। স্কলারশিপ নিয়ে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে চলে যাই। সেখানে পড়ালেখা শেষ করে চাকরিসূত্রে ভারত, জার্মানি, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও কয়েকটি দেশে বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। এরপর দেশে ফিরে গানের জগতে ঢুকে পড়ি।
গানের মানুষ অরুণ...
২০১০ সালে কলকাতায় মাস খানেক ছিলাম। তখন ক্ল্যাসিকাল গিটার বাজানো শিখি। এরপর দেশে ফিরে ইফতেখার আনোয়ারের কাছে ক্ল্যাসিকাল গিটারের তালিম নিই। ২০১১ সালে ক্লাসিক্যাল মিউজিক একাডেমি অব ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হই। শুরুর দিকে শেখাতাম। এখন প্রতিষ্ঠানটির হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক পরিবেশনায় অংশ নিচ্ছি। শিল্পকলা একাডেমি, ছায়ানটসহ বিভিন্ন জায়গায় অর্কেস্ট্রাল মিউজিক পারফর্ম করেছি। ক্ল্যাসিকাল গিটারের পাশাপাশি ট্রামপেটও বাজাই আমি। বিটিভিতে ‘ঐকতান’ এবং ‘চির শিল্পের বাড়ি’ অনুষ্ঠানের বেশ কয়েকটি পর্বে অংশ নিয়েছি। সামনে ‘চির শিল্পের বাড়ি’ অনুষ্ঠানের আরও কয়েকটি পর্বে কাজ করব।
সংগীত নাকি অভিনয়...
সংগীত এবং অভিনয় দুটিই শিল্প। শিল্পের সব শাখাই আমার ভালো লাগে। সংগীত আমার প্যাশন। এর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেশি। অন্যদিকে ছোটবেলায় অভিনয় করেছি অনেকটা খেলার ছলে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই শিশু সত্তা থাকে। আমার মধ্যেও আছে। এখনো আমি অন্তরে দীপুকে লালন করি। তাই অভিনয় বিষয়টি আমার মধ্যে আজও রয়ে গেছে। অভিনয়ে ফিরে আসার অনেক ইচ্ছা আছে। গল্প ও চরিত্র ভালো লাগলে ছোট কিংবা বড় পর্দায় নিয়মিত অভিনয় করতে চাই। ক্যামেরার পেছনেও কাজ করার ইচ্ছে আছে আমার।