লেইমা এবং কিছু প্রত্যাশা

মণিপুরি থিয়েটারের লেইমা নাটকের দৃশ্য
মণিপুরি থিয়েটারের লেইমা নাটকের দৃশ্য

বাংলায় একটা কথা আছে—একে তো নাচুনে বুড়ি/ তার উপরে ঢোলের বাড়ি। ঢাকার মনোযোগী নাট্যদর্শকদের অবস্থাটাও হয় নাচুনে বুড়ির মতো, যদি ঢোলের বাড়িটা হয় মণিপুরি থিয়েটারের ঢাকায় কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন।
সুদূর কমলগঞ্জের একটি নিভৃত গ্রামে বসে মণিপুরি থিয়েটারের নাট্যচর্চা এবং তাদের নান্দনিক সব প্রযোজনার শিল্পসৌকর্য সবাইকে বিস্মিত করে। একটি ভালো নাটক দেখার উত্তাপ বুকে নিয়ে হাজির হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডল প্রাঙ্গণে। দর্শকদের অভ্যর্থনা জানাতে নাটমণ্ডলের প্রবেশদ্বারের সামনের নিরিবিলি সবুজ অঙ্গনটিতে ফুলের পাপড়ি ছিটাতে ব্যস্ত মণিপুরি থিয়েটারের কর্মীরা। এটা হয়তো মণিপুরি সম্প্রদায়ের একটি কৃত্য বা আচার। মিলনায়তনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরি সুর আর বাদ্যযন্ত্রে আবহ তৈরি করে চলেছেন একদল শিল্পী। এসব কিছুই লেইমা নাটকের অংশ।
এত কিছু যার জন্য, সেই লেইমা কেমন? নাটকের নামচরিত্রের ‘লেইমা’ একজন নারী। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা তাঁর নাটকে স্পেনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘ইয়ের্মা’ নামের এক বিবাহিত নিঃসন্তান তরুণীর যে মনোজাগতিক দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন, শুভাশিস সিনহা তাকেই বীক্ষণ করার প্রয়াসী হয়েছেন বাংলাদেশের নিভৃত একটি অঞ্চল কমলগঞ্জের মণিপুরি সম্প্রদায়ের পটভূমিতে। কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। টানা এক বছরের নিরলস শ্রমে-ঘামে নির্মিত হয়েছে লেইমা।
লোরকার বিষয়বস্তু, দর্শন, ভাষা, রচনাশৈলী, আখ্যান-বর্ণনারীতি মননশীল বাঙালি পাঠকদের কাছে পরিচিত। নাটক যেহেতু একটি প্রায়োগিক শিল্প, তাই ‘ইয়ের্মা’র মণিপুরি রূপান্তর ‘লেইমা’র কথা বলতে গেলে আমাদের লোরকার কথা না বলে শুভাশিসের কথাই বলতে হবে। শুভাশিস বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় নাটকটি রূপান্তর করেছেন। মৈথিলি মণিপুরি ভাষায় নাটক দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের কমবেশি হয়েছে রতন থিয়ামের নাটকের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় নাটক দেখানোর কৃতিত্ব শুভাশিসেরই। লেইমা নাটকের নামচরিত্র লেইমা এক সনাতন নারী। শাশ্বত এক নারীর মাতৃত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষাই এই নাটকের আখ্যান। নামচরিত্রে জ্যোতি সিনহার অনবদ্য অভিনয় এ নাটকের প্রাণ। জ্যোতি একাই টেনে নিয়ে গেছেন নাটকটি। কখনো কখনো দু-একজন অভিনয়শিল্পী জ্বলে ওঠার চেষ্টা করেও দপ করে নিভে গেছেন। বুড়ি চরিত্রে শুক্লা সিনহা স্বল্প সময়ে তাঁর অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।
বাঙালি দর্শকদের কাছে এ নাটকের সংলাপের ভাষা দুর্বোধ্য মনে হলেও নাটকের নিজস্ব যে একটি ভাষা আছে, তাকে অবলম্বন করে এগিয়েছেন নির্দেশক। তিনি এ নাটকে মণিপুরি ভাষার মতো মণিপুরি সংস্কৃতি, কৃষ্টি বা কৃত্যের নানা উপাদান ব্যবহার করেছেন। তবে সেসবের ব্যবহার আরও প্রজ্ঞার দাবি রাখে। নির্দেশক যেন ভাসা ভাসাভাবে সেসব ব্যবহার করেছেন। ফলে কোথায় যেন একটা ছন্দপতন ঘটে যায়। দেহের ভেতরে যে অন্তর থাকে, সেই অন্তরের সঙ্গেও পোশাকপরিচ্ছদের জুতসই মিল না ঘটলে দেহের মানুষটাকেই খাপছাড়া মনে হয়। মণিপুরি সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তার ব্যবহার আরও নিবিড় হওয়া দরকার ছিল। লেইমা নাটক দেখে মনে হতেই পারে, এটি সাধারণ একটি প্রসেনিয়াম নাটক, তাতে কিছু মণিপুরি নৃত্যগীত মিশেল দেওয়া হয়েছে। নাটকটির অন্তর্কাঠামোতে যদি নির্দেশক আরও গভীর মনোযোগ ও পরিমিতির সঙ্গে মণিপুরি সংস্কৃতির যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারেন, তাহলে এ নাটকটি আরও ব্যাপকভাবে নন্দিত হবে বলে আশা করা যায়।
লেইমা নাটকের পোশাক, কোরিওগ্রাফি ও আলোর কাজ চমৎকার। নিরাভরণ মঞ্চের ব্যাপারটিও সাহসের পরিচয় দেয়। তবে মণিপুরি জীবনযাত্রার আইকন হিসেবে দু-একটি প্রপস ব্যবহার করা হলে মনে হয় মন্দ হতো না। নাটকের আবহসংগীত নিয়ে আরও একটু ভাববার প্রয়োজন আছে। আবহ নির্মাণে যন্ত্রানুষঙ্গের বহুল প্রচলিত গৎ বা বোল ত্যাগ করে মণিপুরি থিয়েটার নতুন কিছু সৃষ্টির মাধ্যমে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে এলেই নাটকটি আরও সাফল্য লাভ করবে।