'....রাজাই শুধু নেই'

ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন  সংগীতশিল্পী মান্না দে। তখন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাত্কারের সময় তোলা ছবি
ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সংগীতশিল্পী মান্না দে। তখন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাত্কারের সময় তোলা ছবি

অভ্যর্থনাটা ছিল ঘাবড়ে দেওয়ার মতো। ভুরু-টুরু কুঁচকে ‘কী চাই’ জিজ্ঞাসাটাকে অভ্যর্থনা বলা যায় কি না, এটা অবশ্য একটা প্রশ্ন বটে! আরে বাবা, আগের দিন টেলিফোনে তাঁর জীবনী-লেখক কলকাতার সাংবাদিকের রেফারেন্স ব্যবহার করে সাক্ষাৎকার চাইতেই রাজি হয়ে গেলেন। সকালে শেরাটন হোটেলে যাওয়ার আগেও ফোনে আরেক দফা কথা বলে নিয়েছি। আর এখন গায়ে ঘিয়ে রঙের শাল জড়িয়ে চেয়ারে বসে থাকা প্রবোধ চন্দ্র দে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করছেন, কী চাই!
বিনয়ভরে বললাম, আপনার খুব ভক্ত। এতবার বাংলাদেশে এসেছেন, কিন্তু কোনো দিন কথা বলার সুযোগ হয়নি। একটু কথা বলতে চাই। ‘ইন্টারভিউ’ কথাটা ঊহ্য রাখাটাই মনে হলো নিরাপদ। ‘বিনয়’টা নিখাদই ছিল। কথাগুলোও মিথ্যা নয়। প্রবোধ চন্দ্র দের সঙ্গে কে কথা বলতে চায়! আমার সামনে বসে ৯০ বছরের যে তরুণ, কবেই তো বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে গেছে তাঁর আসল নাম। যাঁর গানের সঙ্গে জড়িয়ে কৈশোর-যৌবনের অসংখ্য দিনরাত্রি, আমার মতো প্রায় সব বাঙালির প্রেম-বিরহ বাঙ্ময় যাঁর কণ্ঠে, সেই মান্না দে আমার সামনে। আমি একটু একটু কাঁপছি।
মনে হলো একটু প্রসন্ন হয়েছেন। পাশের চেয়ারটায় বসার ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আমার শরীরটা বেশি ভালো না। সন্ধ্যায় আবার প্রোগ্রাম আছে। দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না।’
মাত্র দশ মিনিট! নিতান্তই হতাশ হলাম। সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর তাঁর আত্মজীবনী জীবনের জলসাঘরে কিনে সারা রাত সেটি পড়ে সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি নিয়েছি। হাতে প্রশ্নের দীর্ঘ তালিকা। দশ মিনিটে এর কয়টারই বা উত্তর মিলবে!

কাল সকালে ঘুম ঘুম চোখে টেলিভিশন খুলেই টিকারে দেখা দুঃসংবাদটা যেন টাইম মেশিনে করে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সাড়ে চার বছর পেছনে। সময় দিয়েছিলেন দশ মিনিট, অথচ মান্না দের রুম থেকে যখন বেরোলাম, ততক্ষণে বোধ হয় এক ঘণ্টা দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে! তখন আমি ঘোরের মধ্যে।

জীবনের জলসাঘরে পড়ে হোমওয়ার্ক করে যাওয়ার একটা ভূমিকা ছিল। কোনো গান বা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে দু-একবার সাল-টাল ভুল করছিলেন, সেসব শুধরে দিয়েছি। উনি চমৎকৃত হয়েছেন। তবে সাক্ষাৎকারের প্রায় আড্ডায় রূপ নেওয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল রবীন্দ্রনাথের। প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা যেমন আপনার অনেক গানই গুনগুন করি, আপনি নিজে সবচেয়ে বেশি গুনগুন করেন কোন গান? মান্না দে উত্তর দিলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত। শুধুই রবীন্দ্রসংগীত।’

এই একটা প্রশ্নই খুলে দিয়েছিল মান্না দের আবেগের দুয়ার। দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধ গড়ে দিল ওই রবীন্দ্রসংগীতই। উনি একটা বলেন, আমি আরেকটার কথা মনে করিয়ে দিই। একটার পর একটা গান আসে আর মান্না দে গাইতে শুরু করেন। গাইতে গাইতে তাঁর চোখ ভিজে যায়। নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে করতে আফসোসও হয়, আহা, ক্যাসেট তো শুধু কথাগুলোই ধরে রাখছে। মান্না দে আমাকে গান শোনাতে শোনাতে কাঁদছেন—এই দৃশ্য তো ভিডিওবন্দী করে সযতনে আর্কাইভে রেখে দেওয়ার মতো!

কী দুঃখ, ভিডিও তো দূরের কথা, অনেক যত্ন করে রেখে দেওয়া ক্যাসেটটাই এখন খুঁজে পাচ্ছি না। মনকে যতই বোঝাই, অনিত্য এই জীবনে সবকিছুই তো হারিয়ে যায়। কিন্তু তাতেও মান্না দের কথা আর গান বুকে নিয়ে থাকা ওই অমূল্য ক্যাসেটটি হারিয়ে ফেলার দুঃখ যায় না!

২০০৯ সালের মার্চে প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া সাক্ষাৎকারটিতে স্থানাভাবে ওই কথোপকথনের এক-তৃতীয়াংশ মতো ছাপা হয়নি। যেটুকু ছাপা হয়েছিল, সেটি কাল কয়েকবার পড়লাম। পড়তে পড়তে চোখের সামনে ছবির কোলাজ। গলা চেপে চেপে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াকে ব্যঙ্গ করে কেমন মজার ভঙ্গি করে নাকি সুরে ‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’ গেয়ে বলেছিলেন, ‘আরে গাধা, ঝড় কি এভাবে আসে নাকি!’ জীবনে কত ভাষায় কত রকম গান গেয়েছেন, রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর কাছে সবার ওপরে।

বাংলা গান দিয়েই আমাদের হূদয়ে মান্না দের অধিষ্ঠান। অথচ সেই বাংলাই গাইতে শুরু করেছেন অনেক পরে। লক্ষ্য ছিল সর্বভারতীয় গায়ক হওয়ার। তত দিনে মুম্বাইতে তিনি প্রতিষ্ঠিত। প্রথম বাংলা গান রেকর্ড নিতান্তই দুর্ঘটনাক্রমে। সেটি শুনেছিলাম তাঁর মুখেই, ‘আমি আর লতা (মঙ্গেশকর) অমর ভূপালী বলে একটা ছবির গান করছিলাম। ওই ছবিতে আমি আর লতা যখন গান রেকর্ড করছি, লতা আমাকে বলল, “মান্নাদা, আমি বাংলা গানের রেকর্ড বের করতে চাই।” লতার জন্য গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দুটি গান আমি সুর করে লতাকে শেখালাম। এরপর রেকর্ডিংয়ের জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু জানি না, কেন লতা গাইতে পারল না অথবা গাইল না। তো আমি গেয়ে দিলাম ওই দুটি গান, “কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো” এবং “হায় হায় গো রাত যায় গো”। ওই দুটি গান শুরুতে তেমন সাড়া না ফেললেও পরে দারুণ হিট হলো। এটাই বাংলা গানে আমার প্রথম পদার্পণ।’

এরপর তো বাঙালির শয়নে-স্বপনে, ঘুমে-জাগরণে মান্না দের অবাধ বিচরণ। ওই আড্ডায় পছন্দ-অপছন্দের কথাও বলেছিলেন নির্দ্বিধায়। কী একটা কারণে সমসাময়িক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা তুলতেই থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘না, না, না, এঁদের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। এঁদের গানের ব্যাপারেও না। এঁরা পপুলার আর্টিস্ট ছিলেন, পপুলার থাকতে দিন। তবে গান করার যে জায়গাটা, সেখান থেকে আমি এঁদের মোটেই পছন্দ করি না।’

যেখানে প্রাপ্য, সেখানে আবার প্রশংসায় অকৃপণ, ‘আমি পছন্দ করতাম হেমন্তবাবুর গান। এত সাদাসিধে গান করতেন আর এমন মিষ্টি গান যেন লোকেদের কাছে আস্তে করে গানটা তুলে দিতেন তিনি আর লোকেরাও দু হাত বাড়িয়ে তা লুফে নিত।’ নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন, হেমন্তর ওই কণ্ঠের (‘অমন সুন্দর গলা’) সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা সম্ভব নয় বলে চিন্তাভাবনা করেই ক্লাসিকাল ভিত্তির ওপর নিজের গায়কিটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকর ও মোহাম্মদ রফিকে নিয়ে সেকি উচ্ছ্বাস! লতাকে বলেছিলেন ‘গানের টোটাল ইনস্টিটিউশন’, কিশোর কুমারের কণ্ঠকে ‘ঈশ্বরপ্রদত্ত গোল্ডেন ভয়েস’।

অনেক দিন ধরেই জীবন্মৃত হয়ে বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে। যখনই মান্না দে সংক্রান্ত কোনো খবর পড়তাম, গুনগুন করতাম তাঁরই গান, ‘ও শেষ পাতা গো, শাখায় তুমি থাকো...’। শেষ পর্যন্ত সেই ‘পাতা’ যখন ঝরেই গেল, তখনো মনে গুঞ্জরিত তাঁরই গান।

মুকুটটা তো পড়েই আছে, রাজাই শুধু নেই।

 ই প্রথম আলোয় পড়ুন: গানই আমার জীবন: মান্না দে