সুদীপের এক ছত্র

সুদীপ চক্রবর্তী। ছবি: আনন্দ
সুদীপ চক্রবর্তী। ছবি: আনন্দ

উচ্চমাধ্যমিকের পর প্রথমবার ভর্তি হয়েছিলেন সিলেটের এমসি কলেজে, ইংরেজি সাহিত্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন পরের বছর। তখনই তিনি জানলেন, স্নাতক পর্যায়ে এখানে নাটক বিষয়ে পড়া যায়! আনন্দে নেচে উঠল সেদিনের সেই কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য তরুণের মন। কারণ, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে নাটক নিয়েই তো তখন কাটে তাঁর দিনকাল। পরের গল্প হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেন তিনি। কিন্তু ইতিমধ্যেই তিনি তো ইংরেজি সাহিত্যে পড়ছেন সিলেটের এমসি কলেজে—মনে দোলাচল, কী করবেন এখন? জানতে চাইলেন মায়ের কাছে। সে সময় মা পার্বতী চক্রবর্তী ছেলেকে বললেন, ‘তোর যেটা ভালো লাগে, যা করে তুই আনন্দ পাস, সেটাই কর।’
এ গল্প ১৯৯৯ সালের, এ কাহিনি তরুণ নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তীর। কয়েক বছরের মধ্যে মহাজনের নাও, লাল জমিন, ম্যাকবেথ, চাকা, দক্ষিণা সুন্দরীসহ বেশ কিছু মঞ্চনাটকের নির্দেশনা দিয়ে নাটকপাড়ার লোকজনের নজর বেশ ভালোভাবেই কেড়েছেন তিনি। আন্তর্জাতিক নাট্যাঙ্গনেও পা ফেলছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু সেদিন মায়ের সেই কথাই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে তাঁর।
২৬ জুলাই প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে সুদীপ যখন কথা বলছিলেন, বারবার বলছিলেন মায়ের কথা, ‘মায়ের এই কথাই আমার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। তখনই ভেবেছি, নাটক নিয়েই থাকব। একসময় ব্যস্ত অভিনেতা হতে চাইতাম। পরে নাট্যনির্দেশনার আনন্দ পেয়ে বসে আমাকে।’
অভিনয় করার স্বপ্ন দূরে ঠেলে সুদীপ যে পুরোদস্তুর নির্দেশক হয়ে উঠলেন, তার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্ট্রাডিজ বিভাগের অবদান অনেকখানি। এ প্রসঙ্গে সুদীপ বললেন একটি গল্প, ‘আমি তখন নাট্যকলায় প্রথম বছর পার করেছি। একটি উন্নয়ন নাটকের মাঠ-গবেষণার অংশ হিসেবে অভিনয় করতে শিক্ষকদের সঙ্গে গিয়েছি কক্সবাজারের চকোরিয়ায়। তো, নাটক শেষে উপস্থিত দর্শক আমাকে মাথায় তুলে নাচল। এ ঘটনার পর আমার বিভাগের একজন শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন আমাকে, “নাটকে পড়তে এসে এখন তোমার কী মনে হচ্ছে?” স্যারকে বলেছিলাম, আগে যখন নবীগঞ্জে নাটক করতাম, অনেক কিছুই বুঝতাম না, করার আনন্দে করতাম। কিন্তু এখন নাটকে পড়তে এসে বুঝছি, এটা অনেক বড় ক্ষেত্র। এখানে সাঁতার কাটতে কাটতে আমি শিখতে চাই।’
এ ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। একদা নাটক বিভাগের শিক্ষার্থী সুদীপ এখন ওই বিভাগেরই শিক্ষক। তার ওপর বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্বও এ মুহূর্তে তাঁর কাঁধে। শেখার কি শেষ হয়েছে তবু?
‘না।’ উত্তর বাতলালেন সুদীপ, ‘আসলে প্রতিনিয়তই তো নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আর নাটক, নাট্যপ্রয়োগও তো নতুন নতুনভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই শেখার কি শেষ আছে?’
শিখতে শিখতেই বেশ কয়েকটি দর্শকনন্দিত প্রযোজনা মঞ্চে এনেছেন এই তরুণ নির্দেশক। নাট্যনির্দেশনা ও গবেষণার কাজ করছেন ইংল্যান্ডেও। ঊষা গাঙ্গুলীর আমন্ত্রণে বর্তমানে সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল নাটকের নির্দেশনা দিচ্ছেন কলকাতার রঙ্গকর্মীতে। বললেন, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মঞ্চে আসতে পারে নাটকটি।
নাটক নিয়ে তরুণের আছে নতুন কিছু ভাবনা। সেই ভাবনার কথা নাহয় তাঁর মুখ থেকেই শোনা যাক, ‘মঞ্চনাটকে পেশাদারত্ব প্রয়োজন—কথাটি আমরা সবাই বলছি। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আমাদের একটি জাতীয় নাট্যদল গঠনের সময় এসেছে। এটা তো ব্যক্তি উদ্যোগে সম্ভব নয়। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। জাতীয় ফুটবল দল, ক্রিকেট দলের মতো সরকার যদি যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করে জাতীয় নাট্যদল গঠনে উদ্যোগ নেয়, তাতে একদিকে যেমন নাটকে পেশাদারির পথ সুগম হবে, তেমনি মঙ্গলময়তার পথেও দেশ এগিয়ে যাবে আরও একধাপ।’