'নাটক আর নাটকের লোকের হাতে নাই'

চঞ্চল চৌধুরী
চঞ্চল চৌধুরী
মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী। অভিনয়ের কারণে পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর ঝুলিতে আরও আছে কয়েকবার পাওয়া মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারও। এবারের ঈদে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সব মিলিয়ে তাঁর তিনটি এক ঘণ্টার নাটক আর তিনটি ছয় পর্বের ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হওয়ার কথা রয়েছে। কয়েক বছর ধরে ঈদ কিংবা অন্য উৎসবে নাটকে পুরোনোদের পাশাপাশি নতুনদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নতুনদের সম্পর্কে তাঁর নিজের মতামত ও এখনকার নাটকের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের

ঈদ তো শেষ হলো। আবারও কী শুটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?
নাহ্‌। আমি আজও বাসায়। পরিবারকে সময় দিচ্ছি। কয়েক দিনের মধ্যে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব।
কয়েক বছর ধরে টিভিতে নতুনদের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। তাঁদের কাজ কেমন মনে হচ্ছে?
অভিনয়শিল্পী হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, তা এ প্রজন্মের কারওর মধ্যেই নেই। এখন যাঁরা অভিনয় করছেন তাঁদের অভিনয়ের প্রস্তুতি কী তা নিয়ে আমি রীতিমতো সন্দিহান! অভিনয় শেখার জন্য তাঁরা সবাই কতটা সময় দিয়েছেন কিংবা দিচ্ছেন। আমরা আসলে যে জিনিসটাই করি না কেন, সেটা তো শিখে এসেই করা উচিত নাকি? এখন যাঁরা নতুন প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রী দাবি করছেন, পর্দা জুড়ে থাকছেন, পর্দা ভরে থাকছেন— এঁদের কতজন আসলে অভিনয় শিখে এসেছেন। অনেকের কাছে আজকাল এমনও শুনতে পাই, অমুক জন্মগতভাবেই প্রতিভাবান। মানলাম জন্মগতভাবে প্রতিভাবান, কিন্তু তাঁকে তো চর্চা আর সাধনার মধ্যে থাকতে হবে। আর তা করতে হলে অবশ্যই সময়ও দিতে হবে। কিন্তু তা কি আমরা করতে পারছি?
আপনি নিজেও তো সেই নতুনদের সঙ্গেই কাজ করছেন ...
আমরা কিন্তু একটা পদ্ধতিতে কাজ করছি। আমরা একভাবে শিখে এসেছি, এখন যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা সেভাবে আসেননি। আমার কাছে মনে হয়েছে, নতুনদের মধ্যে কাজটা প্রাধান্য পায় না, সবচেয়ে প্রাধান্য পায়, কীভাবে তাঁরা মুখ দেখিয়ে তারকা হবেন। অভিনয়গুণে দর্শককে মুগ্ধ করার প্রবণতা এখনকার বেশির ভাগ নতুনের মধ্যে নেই। একই জিনিসই তাঁরা বারবার করছেন। কোনো বৈচিত্র্য নাই। অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে, তাঁরা অভিনয়ের চেয়ে মেকআপের প্রতি বেশি মনোযোগী। অথচ চরিত্র অনুযায়ী মেকআপের প্রতিও তাঁদের কোনো খেয়াল নাই। মোট কথা, তাঁকে যে কোনোভাবেই হোক সুন্দর দেখা যেতে হবে। একটা কাজ করে, ১০-১৫টা পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে তাঁর ছবি কীভাবে আনা যায় সেই কৌশল বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোন মানের কাজ করলেন না করলেন— এই প্রজন্মের তাতে কিছু যায় আসে না। ফেসবুকে কার কতজন ফলোয়ার বাড়ল, কার ছবিতে কয়টা লাইক পড়ল, আবার কেউ কেউ ফেসবুক, ভাইবার, ইনস্টাগ্রাম ভেরিফায়েড হলো কিনা এসব নিয়ে গবেষণায় মেতে থাকেন।
ফেসবুকের ফ্যান ফলোয়ার বাড়া কিংবা ভেরিফায়েড হওয়াটাই কী একজন শিল্পীর গুণমান ও জনপ্রিয়তার মানদণ্ড?
আমার সঙ্গে যখন একজন নতুন অভিনয়শিল্পীকে নেওয়া হয় তখন জানতে চাই, কোন কাজটা তিনি করেছেন? তখন বলার মতো কোনো কাজ খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ তাঁরা নাকি স্টার! আমি নিজে মিডিয়াতে কাজ করেও তাঁদের নামটা পর্যন্ত জানি না। যেখানে আমিই তাঁদের সম্পর্কে জানি না, সেখানে দর্শক জানবেন কোত্থেকে? দর্শক তো একজন শিল্পীকে চিনবেন তাঁর কাজ দিয়ে, যোগ্যতা দিয়ে। ফেসবুকের ফ্যান-ফলোয়ার বাড়া কিংবা ভেরিফায়েড হওয়ার অন্য একটা তরিকা আছে। আমি সেদিকে যেতে চাই না। কেউ তাঁর ফেসবুকে যত আকর্ষণীয় ছবি পোস্ট করবেন, ততই তাঁর ফ্যান-ফলোয়ার আর ছবিতে লাইকের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। সেটা অবশ্যই অভিনয়ের আকর্ষণে নয়। আমাদের দেশে অনেক গুণী অভিনয়শিল্পী কিংবা সংগীতশিল্পী আছেন, যাঁরা ফেসবুকই ব্যবহার করেন না। গুণীদের অনেকেই আবার যখন ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাঁদের ফ্যান-ফলোয়ার কমই দেখতে পাই। তার মানে কী তিনি কম জনপ্রিয়, কিংবা গুণী নন!
আপনিও তো ফেসবুক ব্যবহার করেন ...
আমার ফেসবুক ফলোয়ারের সংখ্যা ৭০ হাজার। তার মানে দেশে ও দেশের বাইরে আমার কী শুধুমাত্র সত্তর হাজার ভক্ত! আমার মনে হয়, বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ-সাত কোটি লোক আমার নাটক দেখেন। আমি সবাইকে বলতে চাই, ফেসবুকের ফ্যান-ফলোয়ার বাড়ানোর দিকে মনোযোগী না হয়ে আমরা সবাই যেন অভিনয়ে কিংবা নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী হই। আমাদের প্রজন্ম নানাভাবে দর্শক ধরে রাখতে পেরেছি কিন্তু এখনকার প্রজন্মের কারও মধ্যেই তার কোনো সম্ভাবনাই দেখছি না। দর্শকের কাছে তাঁরা নিজেদের অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে গ্রহণযোগ্য করার চাইতে স্টার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

চঞ্চল চৌধুরী
চঞ্চল চৌধুরী

তাহলে নাটকের ভবিষ্যৎ কী?
ভবিষ্যৎ মোটেও ভালো না। প্রতি বছর ঈদে দু শ থেকে আড়াই শ নাটক বানানো হয়। তবে, এর মধ্যে যে আট থেকে দশটা নাটক যে ভালো হচ্ছে না তা কিন্তু না। দুঃখজনক হচ্ছে, এই আট থেকে দশটা নাটক লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। এর আরেকটা কারণ হচ্ছে, নাটকটি হয়তো প্রাইম টাইমে প্রচারিত হচ্ছে না। আবার ভালো নাটকগুলোর প্রচার পত্রপত্রিকাতেও তেমন গুরুত্ব পায় না। প্রচার হয়, সেই সব তথাকথিত স্টারদের পতিত নাটকের। ভালো নাটকগুলো নীরবে-নিভৃতে টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে, আমরা তার কোনো খোঁজ-খবরও রাখি না। আস্ফালন করতে থাকি লবিংয়ের নাটকগুলো নিয়ে। ভালো নাটক আবার চ্যানেলে বিক্রি করা যায় না। বিক্রি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক দাম পাওয়া যায় না। ভালো নাটক যাঁরা বানাবেন, তাঁরা এতে করে আগ্রহও হারিয়ে ফেলেন। তা ছাড়া ইদানীংকালে নাটক তো এজেন্সির হাতে চলে গেছে। দেখা যাচ্ছে, আগে আমরা যে নাটক চার লাখ টাকা বাজেটে করতাম সেই নাটকই এখন বানাতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়। আমাদের চারপাশের সবকিছুরই দাম বেড়েছে, শুধু বাড়েনি নাটকের বাজেট।
মোটা দাগে একটা কথা বলতে চাই, যে নাটক নাটকের লোকের হাতে থাকার কথা ছিল, সেই নাটক কিন্তু নাটকের লোকজনের হাতে নাই। নাটক এখন অন্য মানুষের হাতে। নাটক এখন শিল্পের জায়গা থেকে সরে পুরোপুরি ব্যবসার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এটাও সত্য, ব্যবসা করতে গেলে শিল্পমানের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আগে শিল্পমান, তারপর ব্যবসা।