ভয়ার্ত সময়ের মানবিক বীরত্ব

অনিল বাগচীর একদিন ছবির দৃশ্যে সৈয়দ আরেফ ও জ্যোতিকা জ্যোতি
অনিল বাগচীর একদিন ছবির দৃশ্যে সৈয়দ আরেফ ও জ্যোতিকা জ্যোতি

উৎসবে মেলায় হাজারো বর্ণিল আনন্দময় প্রাণের জোয়ারে ছুটে আসা সাপের আক্রমণ জাগিয়ে দেয় ধূসর সময়কে অথবা জেগে ওঠে ভয়ার্ত অনিল অন্ধকারে একা। টর্চের আলোয় সময়, স্থান এবং স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণাময় বাণীর ছোট ছোট শট চলচ্চিত্র বা চরিত্রের গন্তব্য নির্দিষ্ট করে দেয়। সময়ের ভেতরের অনেকগুলো সময় বহে যায় অনিলের যাপনে। কিন্তু অনিল প্রতিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একক সত্তা নয়। যখন সময়টা ১৯৭১, তখন সামষ্টিক জনগোষ্ঠীর ভীতি জেগে থাকে চারপাশে। ছবিজুড়ে দেখি ভয়ের বিস্তার। সেই ভয় যা গ্রাস করেছিল সমগ্র দেশকে। চলচ্চিত্রে দেখি আপাতনিরীহ ভয়ার্ত সেই জনপদ প্রতিরোধী হয় মানবিক নিজস্ব বীরত্বে।
চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামের নতুন চলচ্চিত্র অনিল বাগচীর একদিন। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাসের চিত্রায়ণে মোরশেদুল ইসলাম সময়কে ভেঙেছেন চলচ্চিত্রিক দক্ষতায়। সময়ের স্তরকে তিনি দৃশ্যায়নে রং এবং রংহীনতায় ভাষা দিয়েছেন। দুঃসহ যাপনের বর্তমানকে তিনি রংহীন ধূসর করে দিয়েছেন, অথচ অতীতের সুন্দর যাপনকে রেখেছেন রঙিন। যদিও যুদ্ধদিনের ধূসর বর্তমানও ভাষা হয়ে উঠেছে অনিল বাগচীর একদিন ছবিতে।
একজন সাধারণ মানুষ অনিল বাগচী। বিমা প্রতিষ্ঠানের চাকুরে। বয়স ২৬ বছর। যুদ্ধের সময় ঢাকায় মেসে থাকে অনিল। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে একমাত্র দিদির নিরাপত্তার কথা ভাবে। অন্যদের নিষেধ সত্ত্বেও রওনা হয় টাঙ্গাইলের উদ্দেশে। পথে পাকিস্তানি আর্মির হাতে নিহত হয় ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।
আমরা তার সেই একদিনের যাপন দেখি। ঘুম থেকে ভয় পেয়ে জেগে ওঠার মধ্য দিয়ে যাপনের শেষ দিনটি শুরু হলেও অনিলের দিন শেষ হয় নির্ভয়ে। যে মৃত্যুর ভয় অনিলকে তাড়া করেছিল, সেই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনিল শান্ত, স্থির। জ্যোৎস্নালোকিত রাতের জলমগ্ন শান্ত নদীর তীরে অনিলের চোখ স্থির হয় পূর্ণতায়। সে বলে ওঠে তার আদর্শবান শিক্ষক বাবা সুরেশ বাগচীর উক্তি, ‘প্রকৃতির মাঝে এমন কিছু সৌন্দর্য লুকানো থাকে, যা হৃদয়ে ধারণ করতে হয়, অন্য কোনোভাবে ধরে রাখা যায় না’!
অনিলের একদিনের চিত্রনাট্যের ভাঁজে ভাঁজে আমরা দেখি অনিলের বাবা সুরেশ বাগচী, দিদি অতসী এবং কাকা বরুণের সামষ্টিক জীবনের খণ্ডচিত্র এবং দেখি সেই সব মানুষের দিনলিপি, যারা বেঁচেছিল ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে। আমরা দেখি যাদের অনিল দেখেছিল সেই দিন অথবা তার অতীতের যাপনে। আমরা যা দেখি, তা-ই অনিল দেখে। চিত্রনাট্য এমনি দক্ষতায় বর্তমান এবং অতীতের ঘটনাক্রমকে সূচিকর্মে সাজিয়ে তোলে, যেন মনে হয় এই বাংলার মানুষের হাজার বছরের যাপিত জীবনের নকশিকাঁথার মাঠ। চলচ্চিত্রের শুরু থেকে অতীত এবং বর্তমান এগিয়ে যায় অনিবার্য পরিণতির দিকে। যেন নিয়তি নির্ধারিত এই যাত্রা!
অবিরাম সবুজের ল্যান্ডস্কেপ, বিদ্যুতের খুঁটিহীন সুন্দর গ্রামীণ মহাসড়ক অপু রোজারিওর ধীরগতির ক্যামেরা সঞ্চালনে মনে হয় একখণ্ড অতীত। কোথায় পেলেন এমন চমৎকার লোকেশন?
চলচ্চিত্রের শুরুতে ছোট ছোট শটে দৃশ্যগঠনে যে গতিশীলতা তৈরি হয়েছিল, তা ছবির শেষে এসে ধীর হয়েছে। ছবি শুরুর ভয়ার্ত দৃশ্যময়তা থেকে ছবি শেষের শান্ত এবং স্থির সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিণত দৃশ্যায়নে অপু রোজারিও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। ভালো লেগেছে ছবির শব্দের আবহ। নিঃসন্দেহে গুণী শব্দ প্রকৌশলী রতন পালের যত্ন কানে ধরেছে। অনিল বাগচীর একদিন ছবির আত্মমগ্ন দৃশ্যশালায় এই ছবির শব্দের ডিজাইন দর্শক হিসেবে ছবির ভেতরে প্রবেশের সহজ পথ তৈরি করে দেয়।
সানি জুবায়েরের সংগীত আবেদন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে অনিলের দিদি অতসীর একাকিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহৃত গানটি ছবির গল্পে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। অনিলের দেশাত্মবোধক গানটির দৃশ্যায়নে অপু রোজারিও মায়াময় আবেগ সৃষ্টি করতে পারেননি। গানটির দৃশ্যায়ন খুব সাধারণ মনে হয়েছে।
অনিল এবং অতসী চরিত্রের শিল্পী নির্বাচন ভালো হয়েছে। অনিল বাগচীর চরিত্রে সৈয়দ আরেফ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। নিঃসন্দেহে আরেফ অনিল চরিত্রকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। অতসী চরিত্রে জ্যোতিকা জ্যোতির স্বল্পসময়ের প্রায় মৌন উপস্থিতি স্নিগ্ধতায় ভরা। তার অভিব্যক্তিতে চরিত্রের একাকিত্ব ও অপেক্ষা অনুভব করা গেছে। একইভাবে আইয়ুব আলীর স্ত্রীর ভূমিকায় ফারহানা মিঠুর উপস্থিতি সুন্দর ও প্রাণবন্ত হয়েছে। অন্যদিকে সুরেশ বাগচীর ভূমিকায় মঞ্চের গুণী অভিনেতা তৌফিকুল ইসলাম একঘেয়ে অভিনয় করেছেন। এই চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যত্নের প্রয়োজন ছিল, তা করতে তিনি ও নির্মাতা ব্যর্থ হয়েছেন। যা ছবিটির স্পিরিটকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একইভাবে পাকিস্তানি আর্মির কর্নেল চরিত্রে মিশা সওদাগর হাস্যকর অভিনয় করেছেন। তাঁর অল্প সময়ের উপস্থিতি ছবিকে ঋণাত্মক করে তুলেছে।
অনিল বাগচীর একদিন ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আইয়ুব আলীর ভূমিকায় গাজী রাকায়েত হুমায়ূন আহমেদের ‘আমুদে’ চরিত্র হিসেবে খারাপ করেননি। তবে আরেকটু যত্নের সঙ্গে তিনি এই চরিত্রের ভেতরে ঢুকতে পারলে অসাধারণ একটি চরিত্রের জন্ম হতে পারত। যা ছবির আবেগকে আরও তীব্র মাত্রা দিতে সক্ষম হতো। যে কারণে অনিলের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মুহূর্তে তার চিৎকার করে দেওয়া সংলাপও কিছুটা প্রাণহীন মনে হয়েছে। কান্না জড়ানো চিৎকার হৃদয়ে কান্নার আবেগকে স্পর্শ করেনি। যতটা করেছে সংলাপহীন সেই মেয়েটির চিৎকারে। যাকে বৃদ্ধ বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল পাকিস্তানি আর্মির সদস্যরা।
শেষ পর্যন্ত অনিল বাগচীর একদিন এক অনন্য চলচ্চিত্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ‘যুদ্ধ’ধর্মী চলচ্চিত্র হয়েছে। অনিল তা নয়। অনিল ‘মুক্তি’ধর্মী চলচ্চিত্র। সরল এবং ভয়ার্ত একজন বাঙালি নিজস্ব ভীতির দেয়াল ধসিয়ে কেমন করে সৎ সাহসী যোদ্ধায় রূপান্তরিত হয়, তার অসাধারণ আবেগময় চিত্রময়তার চলচ্চিত্র অনিল বাগচীর একদিন। তিন দশকের গুণী চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলামকে এই ‘মুক্তি’ধর্মী চলচ্চিত্রের জন্য জানাই অভিনন্দন!
লেখক: নির্মাতা ও সংগঠক