সেদিন দুজনে

.
.

শ্রাবণীর মনে ছিল কি না জানি না। তখন কেবল ঢাকার পত্রিকার হকাররা পত্রিকা দিয়ে আসছে। সকালটা প্রতিদিনের মতোই স্নিগ্ধ। আমি কলবেল চেপে তাকে ফুলগুলো দিয়ে চলে আসি। আমি জানি, শ্রাবণী আবার অবাক হবে। আমার ভালোবাসা নিয়ে দ্বিধায় থাকবে। হয়তো কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করবে। শ্রাবণীকে ভালোবেসে কোনো ফাল্গুন-চৈত্রে গৃহত্যাগী হতে চাই। তাই বলে তাকে নিয়ে সংসার করতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। শ্রাবণী আমার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়। এতে আমার বন্ধুমহলে এত আলোচনার কী আছে। শিল্পা সেদিন তো বলেই বসল—
তুই একটা নির্লজ্জ, বেহায়া। কোন হিসেবে বড় মেয়েদের প্রেমে পড়িস!
-আমার লজ্জা করে না। তোর যদি করে, তাহলে তুই আমার কাছ থেকে দূরে থাকিস কিংবা বলে দিস, আমি তোদের কাছে আসব না।
তারা আমাকেও ছাড়বে না, আবার খোঁচাও মারবে। শ্রাবণীর সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক না। তবে তার প্রতি আমার প্রগাঢ় আবেগ জমে যায়, যখন আকাশে গাঢ় হয়ে চাঁদ ওঠে, কিংবা মধ্যরাতে আকাশের গায়ে নীলচে আভার পর্বতমালা ছড়িয়ে যায়। শ্রাবণীর সঙ্গে একটা সরু রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। ওর সাপ্তাহিক ছুটির দিন সে আমাকে সময় দিয়ে কৃতার্থ করে।
সকালে শ্রাবণীর বাসা থেকে এসেই কেরানীগঞ্জে চলে যাই। সারা দিন অকাজের কাজ ছেড়ে যখন পুরান ঢাকার গলি দিয়ে হেঁটে ফিরছি, তখনই শ্রাবণীর ফোন—
-কোথায় তুমি
-আমি, আমি, এই তো তুমি কোথায়?
-আমি টিএসসিতে।
-আরে, আমি তো নিউমার্কেটের কাছে।
-দাঁড়াও, পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে আসছি।
রিকশায় টিএসসিতে আসতে ১৫ মিনিট লাগল। মাত্র ১৫ মিনিটে! আমি নিজেও অবাক।
গাঢ় নীলচে শাড়িতে শ্রাবণীকে সন্ধ্যার আলোয় কেমন লাগছে, বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। বেচারি বাচ্চাদের মতো বসে কবিতার বই পড়ছে। আমি পাশে গিয়ে বসি।
‘সকালে ওভাবে চলে এলে কেন?’ শ্রাবণীর প্রশ্ন।
আমি চুপ করে থাকি। আমার পেটে অনেক কথা। মুখে আসে না। শ্রাবণীর সামনে এলে আমি কথা হারিয়ে ফেলি। আমার শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। পাশাপাশি হাঁটতে ইচ্ছে করে। মনে মনে বলি, ছয়টি ফুলই তো দিয়েছি। পাশে চার-পাঁচজন ছেলে গলা ছেড়ে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণী কবিতার বই থেকে মাথা ওঠায় না। আমি পাশে আড়চোখে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে নিয়ন আলো ঠিকরে পড়ে ওর মুখে। পৃথিবীর সব মায়া যেন জমা হয়। ভালোবাসা এক অদ্ভুত রোগের নাম। কোনো কোনো সময় বেহিসাবি নিয়মে চলে।
মাহতাব হোসেন
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।