গাজীর বাঁশি

বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম। ছবি: আনন্দ
বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম। ছবি: আনন্দ
বাড়িতে কেউ গান-বাজনার সঙ্গে জড়িত নন। তবে কলের গানে আব্বাস উদ্দীনের গান খুব শুনতেন তাঁর মা। গুনগুন করে গাইতেন ‘ওরে আমার গহিন গাঙের নাইয়া’। মায়ের অনুপ্রেরণায় বাঁশিকেই প্রতিদিনের সঙ্গী করে ফেলেন গাজী আবদুল হাকিম

‘আমার জন্ম হয়েছে বোধ হয় বাঁশি বাজানোর জন্য।’ বাঁশির সঙ্গে সখ্য কীভাবে হলো—জানতে চাইলে ৬২ ছুঁই ছুঁই গুণী বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিম এভাবেই শুরু করলেন। খুলনার ডুমুরিয়ার যে গ্রামে তাঁদের বাড়ি, সেই এলাকাটি হিন্দু-অধ্যুষিত। প্রতিবছর পূজা-পার্বণে মেলা বসত। মেলায় কীর্তন, বাউলগানের আসর হতো। সবাই ছুটতেন সেই গানের আসরে আর ছোট্ট হাকিম দলছুট হয়ে খুঁজতেন বাঁশির দোকান, বাঁশি কেনার আশায়। চার-পাঁচ বছর বয়সেই হাতে তুলে নেন বাঁশি। বাড়ির পাশে শ্রীনদী। কখনো নদীর পাড়ে বসে, কখনো সেই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে গলুইয়ে বসে বাঁশি বাজিয়ে চলছেন। প্রকৃতির প্রেমে বাঁশি তাঁর বেজে চলত সময়কে থামিয়ে।

গাজী হাকিম বলেন, ‘আমার চারু কাকার বাড়িতে খুব গান হতো। কাকা বাঁশিও বাজাতেন। তাঁর কাছেই প্রথম হাতেখড়ি হলেও আমার প্রথম শিক্ষাগুরু মুকুল বিশ্বাস। দুই গ্রাম পেরিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে রোজ বাঁশি শিখতাম।’
একসময় মুকুল বিশ্বাস চলে যান ভারতে। গাজী হাকিম এরপর তালিম নেন দুলাল বাবুর কাছে। ১৯৭৪ সালে বাঁশিশিল্পী হিসেবে খুলনা বেতারে যোগ দেন তিনি। রেডিওতে বাজানোর পাশাপাশি তালিম নেন ওস্তাদ আলী আহমেদ ও বিনয় রায়ের কাছে। একসময় বদলি হয়ে চলে আসেন ঢাকায়।
গাজী আবদুল হাকিম বলেন, ‘১৯৮৪ সালের শেষ দিকে আমি ঢাকা বেতারে যোগ দিই। একই সময়ে যোগ দিই আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রাতে। রেডিওর পাশাপাশি শুরু হয় চলচিত্র আর অডিও অ্যালবামে নিয়মিত বাজানো।’
চলচ্চিত্রে খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, আজাদ রহমান, আলম খান, আনোয়ার পারভেজের মতো গুণী সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন গুণী এই বাঁশিশিল্পী। অডিওতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সাদি মহম্মদ, অজিত রায়, কলিম শরাফীর রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম অ্যালবামগুলোতে একাই বাজিয়েছেন। দেশের বাইরে প্রথম কলকাতা গেলেও স্মরণীয় সফর ছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ফেরদৌসী রহমান আর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে। এক মাসের সেই সফরে এরপর তাঁরা যান লন্ডনে। গত ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, হল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বিশ্বের অসংখ্য দেশে বাজিয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত বিশ্বের বেশ কটি দেশে তাঁর একক এবং ফরিদা পারভীনের সঙ্গে যুগলবন্দী অনুষ্ঠান হয়েছে। এর মধ্যে লন্ডনের হাউস অব কমন্সে, প্যারিসের লা ভেলি থিয়েটারে ফরিদা পারভীন ও তাঁর যুগলবন্দী হয়। এই অনুষ্ঠানগুলোর ডিভিডিও বেরিয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গাজী আবদুল হাকিম টগবগে তরুণ। কথায় কথায় মুক্তিযোদ্ধা গাজী হাকিমের গল্পও শুনি। ‘আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। যুদ্ধের ডামাডোল বাজছে। মনিরামপুর, কেশবপুর, দৌলতপুর আর ফুলতলার মাঝে আমাদের চেচুঁড়ি গ্রামটি যেন একটা অভয়ারণ্য। রাজাকার, খানসেনাদের হাত থেকে গ্রামটা কীভাবে মুক্ত রাখা যায়, সেই চিন্তা তখন মাথায়। অস্ত্র নেই, ওরা এলে যুদ্ধ করব কী দিয়ে? তাই লাঠি নিয়ে আমরা গ্রামের তরুণেরা পাহারা দেওয়া শুরু করি। এক বিকেলে আমাদের বাড়িতে দুজন মানুষ এলেন চাদর মুড়ি দিয়ে। হাতে ভারী বস্তা। তাঁদের একজন মোজাম্মেল হক, অন্যজন আবদুস সাত্তার। আমার মাকে বললেন, দুই দিন কিছু খাইনি। তাঁদের চাদরের আড়ালে ছিল এসএমজি। আর বস্তায় ছিল প্রচুর গ্রেনেড। মা তাঁদের খেতে দেন। পরে সেই মোজাম্মেল হকের কাছেই আমরা গ্রামের ৩০-৩৫ জন যুবক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। রাজাকাররা গ্রাম আক্রমণ করলে কয়েকবার আমরা তাদের প্রতিহত করি। আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার খবর চলে যায় পাক সেনাদের কাছে। এক রাতে আমাদের গ্রামের ২৬ জনকে একসঙ্গে কাটিংগার স্কুলের মাঠে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে পাক মিলিশিয়ারা। আগস্ট মাসের শেষে সীমানা অতিক্রম করে আমি চলে যাই ভারতে; চব্বিশ পরগনার মোসলান্দোপুরে। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিই।’
গাজী আবদুল হাকিমের দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে মিতা আইনে এলএলবি শেষ করে এলএলএম করছেন। রেডিওতে আধুনিক ও পল্লিগানের তালিকাভুক্ত শিল্পী। ছোট মেয়ে রীনা আর ছেলে সুমন এমবিএ পড়ছেন।
বাংলাদেশ মিউজিশিয়ানস ফোরামের সভাপতি, বাংলাদেশ বেতার নিজস্ব শিল্পী সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল গাজী আবদুল হাকিম স্বপ্ন দেখেন একটি মিউজিশিয়ান ক্লাব করার। বললেন, ‘আমাদের যন্ত্রশিল্পীরা অবহেলিত। তাঁদের জন্য একটি ক্লাব করতে চাই, যেখানে তাঁদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি একটি সংগীত একাডেমি ও অ্যাকুস্টিক বাদ্যযন্ত্রগুলোর সংগ্রহশালা করতে চাই। সংগীত একাডেমিতে নতুন প্রজন্মকে অ্যাকুস্টিক বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখানো হবে। কারণ, অ্যাকুস্টিক বাদ্যযন্ত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি এখনই শুরু করতে হবে।’