হায় রে ফারুক! তোমাকে আরও অনেক দিন চেয়েছিলাম

ফারুক
ফারুক

কিছু কিছু মানুষের বয়স হয় কিন্তু কাজে তা প্রকাশ পায় না। সেই যাঁকে দেখেছি কুড়ি বছরের, এত বছর পরেও দেখছি তেমনই। যাঁরাই অভিনয় করেন, তাঁদের এক ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ মেকআপম্যান। এখন সাধারণত মেকআপম্যান বলা হয় না, বলা হয় মেকআপ আর্টিস্ট। এই আর্টিস্ট আবার সবাই হন না, যেমন সব অভিনেতাই অভিনয়শিল্পী হন না—তেমনই। যথার্থই মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে উঠেছিল মোহাম্মদ ফারুক। চরিত্র নিয়ে অসাধারণ তার কল্পনাশক্তি।
মনপুরা ছবিতে অভিনয়ের আগে পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিম আমাকে দাড়ি রাখতে বলেছিলেন। আমি রেখেও ছিলাম। ভাবলাম আর মেকআপ নিতে হবে না। কিন্তু ফারুক এর মধ্যেই সৃজনশীলতা আবিষ্কার করল। প্রতিটি দাড়ির ফাঁকে ফাঁকে একেবারেই কুচি কুচি করে কাটা ক্রেপ দিয়ে ঘন করে দিলো আমার দাড়িকে। চেহারাই পাল্টে গেল, বিভিন্ন দৃশ্যের অভিনয়ে নতুন মাত্রা পেল। এই মেকআপ নিতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগত। মাঝে মাঝে বিরক্তই হতাম। হয়তো দেড় ঘণ্টা মেকআপ নেওয়ার পর একটি দৃশ্যই শুটিং হতো সারা দিনে।
কলেজে নাটক করার সময় আমাদের অনেকেরই যাত্রা শুরু হয়েছে সুরেশ দত্তের মেকআপ নিয়ে। তিনি তো শাসন করতেন। ঘুরে বেড়াতে দেখলেই জোর করে এনে মেকআপ দিতেন। জিঙ্ক অক্সাইড দিয়ে চুল পাকাতেন। কী অসাধারণ ক্রেপের কাজ! তারপর তাঁর ছেলে বঙ্গজিত দত্তের হাতে পড়লাম। বাবার যোগ্য উত্তরসূরি বটে। চলচ্চিত্রে তখন আশুবাবুর দাপট। টেলিভিশনে সালাম সাহেব, মঞ্চে তিনি আছেন। নানা বৈচিত্র্যময় সব মেকআপ। কিশোর বয়স থেকেই যাত্রা শুরু ফারুকের। কোনো বিশেষ আয়োজনে তা চলচ্চিত্র, টেলিভিশন বা মঞ্চেই হোক, আছে ফারুক। ফারুককে দেখলেই আমরা আনন্দিত হয়েছি, একটা কিছু নতুন হবে। নতুন কোনো মেকআপ, গেটআপ।

বাংলাদেশে এই শিল্পটি এখনো অবহেলিত। ভারতে, হলিউডে বা ইউরোপে যেমন গুরুত্ব পায়, তেমনটি আমাদের দেশে নেই। অনেকটা বঞ্চনা থেকেই এখন মঞ্চনাটকে মেকআপটাই উঠে যাচ্ছে। আলো, কস্টিউম ও চরিত্রের প্রয়োজনে মেকআপ যদিও অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে মেকআপের সুব্যবস্থা ছিল, কিন্তু প্যাকেজ নাটকে মেকআপ বেশ অবহেলিত। এত নাটক হচ্ছে যে যথার্থ মেকআপম্যানেরও অভাব। অথচ কলকাতা বা মুম্বাইয়ে দেখেছি কী কদর তাঁদের! অনেক বড় শিল্পীরই নিজস্ব মেকআপম্যান আছেন। এখানে অর্থনৈতিকভাবেও তাঁরা বঞ্চিত। ফারুকের কোনো অর্থ-সম্পদ ছিল না। যে অসুস্থতায় সে আক্রান্ত হয়েছিল তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এমন একটি পর্যায়ে সে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, যখন করণীয় তেমন কিছু ছিল না। তবুও ডাক্তাররা চেষ্টা করেছেন। তবে এত দূরে চলে যাবে তা ভাবতে পারিনি। যাঁদের সে পরম মমতায় এবং পেশাদারি সৃজনশীলতায় সারা জীবন মুখে হাত বুলিয়েছে, তাঁদের সাহচর্য চাইছিল শেষ সময়ে। কিন্তু সবাই বড় ব্যস্ত। আমরা দুজন যখন হাসপাতালে পৌঁছালাম তখন ডাক্তার স্বপ্নিল এবং অন্য ডাক্তাররা বিষণ্ন, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। চিকিৎসার উপায় আর ছিল না।

আমাদের দেশে যা দেখা যায়, তাই নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কিন্তু নেপথ্যের মানুষের কেউ দেখে না। আমাদের যারা সাজিয়ে দেয়, যারা আলো জ্বালায়, যারা শিল্প নির্দেশনা দেয়, চা-পানি এগিয়ে দেয়, তাদের খবর কেউ রাখে না। অসংখ্য শিল্পী কাজ করেন। দু-চারজন যাঁরা নক্ষত্র হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাই শুধু ভাগ্যবান। নেপথ্যকর্মী, শিল্পীদের কোনো খোঁজখবর নেই। এক কালের গুণীশিল্পী আবদুস সাত্তার রোগে জর্জরিত। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে বহুবার ধরনা দিয়েও কোনো সাহায্য মেলেনি। তেমনি ফারুকের জন্য হয়তো আমাদেরই টাকা তুলতে হতো, প্রস্তুতও ছিলাম কিন্তু সময় মিলল না।

ফারুকের বিদায়ের পর মনে হয়েছে সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। রূপসজ্জায় যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের একটা সংগঠন চাই। সক্রিয় সংগঠন। তাহলে দুর্দিনে তাঁরা পাশে দাঁড়াবেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা পেশাগত মান বাড়াবেন, নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করবেন।

হায় রে ফারুক! আরও অনেক দিন চেয়েছিলাম তোমার কোমল হাত আমাদের মুখটাকে বুলিয়ে দিক।