মুম্বাইয়ের বান্দ্রা এলাকার লিংকিং রোডের ঘটনা। মূলত দুর্ঘটনা। তরুণ শক্তি কাপুর আর সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ফিরোজ খানের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। শক্তি কাপুর চালাচ্ছিলেন তাঁর পুরোনো ১৯৬১ সালের ফিয়াট। আর ফিরোজ খান সদ্য কেনা ব্র্যান্ড নিউ মার্সিডিজ। সংঘর্ষের পর গাড়ি থেকে নেমে মারমুখী ভঙ্গিতে শক্তি কাপুর ছুটে গেলেন বিপরীতমুখী গাড়ির সামনে। সেই গাড়ি থেকে নামলেন ফিরোজ খান। তাঁকে দেখে শক্তি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ‘স্যার, আমি শক্তি কাপুর। ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে এসেছি। মডেলিং করি, অভিনয় পারি। আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। দয়া করে আপনার ফিল্মে আমাকে একটা রোল দেবেন?’
সে সময় ফিরোজ খান ‘কোরবানি’ ছবির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি নিজেই প্রযোজক ও পরিচালক। সেদিন দুর্ঘটনাস্থলে ফিরোজ খান ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেননি।
ভিড় জমে যাওয়ার পর তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। অফিসে গিয়ে চিত্রনাট্যকার কে কে শুক্লাকে ফোন করে জানালেন পথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা। বললেন, ‘ছেলেটাকে (শক্তি কাপুর) ভয়ংকর লাগছিল!’
এই ছেলেকেই খলনায়ক হিসেবে নিতে চান তিনি। লেখক কে কে শুক্লার সঙ্গে শক্তি কাপুরের আগেই কথা হয়েছিল। ফিরোজ খানের কথা শুনে তিনি শক্তি কাপুরকে বললেন, ‘তোমার ভাই কপালটাই খারাপ। তোমার কথাই বলেছিলাম ফিরোজ সাহেবকে। কিন্তু ফিরোজ ভাই আজ কোন এক বদমাশের গাড়ির সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। এখন তিনি ওই বদমাশটাকে ভিলেন হিসেবে নিতে চান!’ শুনে শক্তি কাপুর চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘আরে আমিই তো সেই বদমাশ।’
শক্তিমান অভিনেতা শক্তি কাপুর। বলিউডে তাঁর শুরুটা এ রকমই। আজ গুণী এই অভিনেতা জন্মদিন। ১৯৫৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, দিল্লিতে তাঁর জন্ম। তাঁর আসল নাম সুনীল সিকান্দারলাল কাপুর। অভিনয়ে আসার পর আরেক অভিনেতা সুনীল দত্ত বড়সড় নামটা বদলে রাখেন ‘শক্তি’।
তাঁকে বলা হয় হিন্দি ছবির জগতের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ভিলেন। একটা সময় তিনি ছিলেন শুধুই ভিলেন, পর্দায় নায়কদের মার খেয়ে মরে যাওয়া ছিল তাঁর নিয়তি। এ সময়ের জনপ্রিয় বলিউড তারকা শ্রদ্ধা কাপুর বাবাকে একদিন বলেছিলেন, ‘তুমি কেন সবার হাতে মার খাও? তুমি নায়ক হতে পারো না?’ একমাত্র মেয়ের এ অভিযোগ শুনে বাবা সেদিন হেসেই ফেলেছিলেন।
শক্তি কাপুর সব সময় ভিলেন ছিলেন না। একসময় তিনি হয়ে যান পুরোদস্তুর কমেডিয়ান। মানুষ হাসানোর কাজটি তিনি বেশ ভালোই পারতেন। ‘রাজাবাবু’ ছবির নান্দু, ‘ইনসাফ’–এর ইন্সপেক্টর ভিন্দে, ‘চালবাজ’–এর বাটুকনাথ, ‘বল রাধা বল’–এর গুঙ্গা, কিংবা ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ ছবির সেই বিখ্যাত ক্রাইম মাস্টার গোগোর জন্য ১৯৯৫ সালে পেয়েছিলেন সেরা কমিডিয়ানের পুরস্কার। ভিলেন, কমেডিয়ান বা যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করে তিনি প্রমাণ করেছেন, অভিনয়ে তিনি শক্তিশালী। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তিনি অভিনেতা কাদের খানের সঙ্গে জুটি বেঁধে শতাধিক চলচ্চিত্রে হাস্যরসাত্মক ও খলচরিত্রে মানিকজোড় হিসেবে কাজ করেছেন।
‘আয়া হো, কুচ তো লুটকার জাউঙ্গা-খান্দানি চোর হো ম্যায়, খান্দানি-মোগাম্বো কা ভাতিজা, গোগো’, ‘ক্রাইম মাস্টার গোগো নাম হ্যায় মেরা, আঁখে নিকালকে গোটিয়া খেলতা হো ম্যায়’, ‘জাব কোই বাচ্চা নেহি সোতা, তো উসকা মা ক্যাহতি কি… সো যা, সো যা, নেহি তো গোগো আ যায়ে গা’, এমন অনেক সংলাপ একটা সময় আমাদের দেশেও হিন্দি ছবির দর্শকদের মুখেও শোনা যেত।
বছরের পর বছর শক্তি কাপুর ক্রমেই বলিউডের গুরুত্বপূর্ণ খলনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রায় চার দশক ধরে সাত শতাধিক ছবিতে অভিনয় করে নিজস্ব একটা পরিচিতি তৈরি করেছেন তিনি। অবশ্য চলার এই পথে নামের সঙ্গে কিছু বদনামও কুড়িয়েছেন শক্তি। ২০০৫ সালে একটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম শক্তি কাপুরের একটি খবর ব্রেক করে। কাস্টিং কাউচ কেলেঙ্কারি উঠে আসে তাঁর নাম। একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, এক নারী সাংবাদিক নায়িকা হিসেবে তাঁর কাছে কাজ চাইতে গেলে তিনি বলেন, ‘ফিল্মে কাজ করতে হলে, কাউচে যেতে হবে।’ যদিও শক্তি কাপুর বলেছিলেন, ‘এসব সাজানো। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
শক্তির জীবনের শুরুটা ছিল দারিদ্র্যক্লিষ্ট। দিল্লির কনট প্লেসে একটি দরজির দোকান চালাতেন তাঁর বাবা। পরে সেটির হাল ধরেন শক্তি। ১৯৭৫ সালে যখন প্রথম মুম্বাইয়ে গিয়েছিলেন, তখন থাকার জায়গাও ছিল না শক্তি কাপুরের।
কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রথম আলোচিত ছবি ‘কোরবানি’ করার পরে আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮২ সালে সংগীতশিল্পী শিবাঙ্গী কাপুরকে বিয়ে করেন তিনি। বর্তমানে মুম্বাইয়ের সমুদ্রসৈকতের পাশে বিলাসবহুল আবাসিক কমপ্লেক্সে স্ত্রী শিবাঙ্গী এবং দুই সন্তান শ্রদ্ধা কাপুর ও সিদ্ধান্ত কাপুরকে নিয়ে থাকেন। সিদ্ধান্ত কাপুর অভিনেতা ও সহকারী পরিচালক, শ্রদ্ধা ‘আশিকি টু’খ্যাত বলিউডের জনপ্রিয় তারকা।
ঢাকার ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা। ২০০০ সালে সাঈদুর রহমান সাঈদের পরিচালনায় ‘এরই নাম দোস্তি’ ছবিতে রিয়াজ-শাবনূরের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিনি।